Posts

প্রবন্ধ

প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাঠ ও সমালোচনা

April 12, 2025

মোঃ আব্দুল আউয়াল

Original Author অধ্যক্ষ এমএ আউয়াল

301
View

প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাঠ ও সমালোচনা

ভূমিকা

প্রাচীন পাণ্ডুলিপি বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও ভাষার ক্রমবিবর্তনের এক অপরিহার্য সেতুবন্ধন। এই পাণ্ডুলিপিগুলির পাঠ, সংরক্ষণ এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণে মৌলিক ভূমিকা পালন করে। পুঁথি-সাহিত্য থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় ভক্তিমূলক কাব্য কিংবা প্রাক-মুদ্রণযুগের গদ্যলিপি—এই সবই আমাদের অতীতচেতনার দর্পণস্বরূপ। পাণ্ডুলিপির পাঠ ও সমালোচনা কেবল সাহিত্যের ব্যুৎপত্তিগত ধারা অনুধাবনের মাধ্যম নয়, এটি দর্শন, ইতিহাস ও সমাজতত্ত্ব বোঝার অন্যতম চাবিকাঠি।

প্রাচীন পাণ্ডুলিপি: ধারণা ও গুরুত্ব

পাণ্ডুলিপি বলতে সাধারণত হাতের লিখা সেই সমস্ত গ্রন্থ বা পাঠ্যবস্তুকে বোঝানো হয় যেগুলি মুদ্রণ প্রযুক্তির পূর্ববর্তী যুগে সৃষ্ট। এই পাণ্ডুলিপিগুলির অধিকাংশই তালপাতা, ভোজপাতা, তুলোট কাগজ কিংবা চর্মলিপিতে সংরক্ষিত ছিল। এদের রচনার পদ্ধতি, ভাষা ও লিপি ইতিহাসবিদ, ভাষাবিদ ও সাহিত্যানুরাগীদের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলায় পাণ্ডুলিপির সর্বাধিক নিদর্শন মধ্যযুগীয় সাহিত্য থেকেই সংগৃহীত হয়েছে, যার মধ্যে চৈতন্যভক্ত কাব্য, মঙ্গলকাব্য, বাউলপদ ও লোকজ কথাসাহিত্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[^1]

পাঠপদ্ধতি ও পাঠচ্যুতি

পাণ্ডুলিপি পাঠ একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে একাধিক পাঠরূপ (variant readings) বিশ্লেষণ করে একটি মূল পাঠ নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় পাণ্ডুলিপি কালের প্রভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় কিংবা লেখকের পরবর্তী কোনো সংস্করণ ভিন্ন পাঠ উপস্থাপন করে। পাঠশুদ্ধিকরণের জন্য তুলনামূলক পাঠ (critical edition) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঠান্তরের ভিতর দিয়ে লেখকের চিন্তাধারা, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও সময়ের পরিবর্তনও অনুধাবন করা যায়।

উদাহরণস্বরূপ, মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল পাণ্ডুলিপির একাধিক পাঠভেদ পাওয়া গেছে, যেখানে কোনো কোনো সংস্করণে দেবী চণ্ডীর বর্ণনা আধ্যাত্মিক, আবার অন্য পাঠে তা অধিক মানবিক।[^2] এই পাঠভেদগুলি সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে নতুন ব্যাখ্যার দিগন্ত উন্মোচন করে।

পাণ্ডুলিপি সমালোচনার ধারা

পাণ্ডুলিপি সমালোচনার ক্ষেত্রেও পাঠানুবর্তী নানান ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথমত, গ্রন্থসমালোচনার ভাষাবিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে শব্দচয়ন, ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যগঠন বিশ্লেষণ করা হয়। দ্বিতীয়ত, সাহিত্যতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, যা প্রতীক, উপমা, আখ্যান কাঠামো বিশ্লেষণ করে। তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক-পারিপ্রেক্ষিক বিশ্লেষণ, যেখানে সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব খুঁজে দেখা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত এর প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাঠ ও পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ সুশৃঙ্খল ধর্মীয় বয়ানের মধ্যে সাহিত্যিক অলঙ্কার প্রয়োগে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন।[^3] সমালোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে এটি কেবল একটি ধর্মীয় বৃত্তান্ত নয়, বরং একটি ব্যতিক্রমধর্মী আখ্যানভাষ্যের নিদর্শন।

পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব

প্রাচীন পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ডিজিটাল স্ক্যানিং, ইনফ্রারেড পাঠপ্রযুক্তি, এবং মেটাডেটা সংযুক্তির পদ্ধতি একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাচীন পাণ্ডুলিপির অবিকৃত রূপ সংরক্ষণের পাশাপাশি পাঠকের জন্য এটি সহজপ্রাপ্ত ও পাঠযোগ্য করে তোলা সম্ভব হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুথি সংগ্রহাগার, শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাণ্ডুলিপি সংগ্রহাগার সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এই কার্যক্রমে যুক্ত।[^4]

সমাপ্তি

প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাঠ ও সমালোচনা কেবল ভাষার অতীতচর্চা নয়, এটি এক ধরণের সাংস্কৃতিক প্রত্নতত্ত্ব। এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের উপাদান, যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটায়। তাই পাণ্ডুলিপি পাঠের দায়িত্বশীলতা, পাঠশুদ্ধির সততা এবং সমালোচনার গভীরতা—সবকিছুই মিলেই একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য-ইতিহাস গঠনের ভিত্তি।

পাদটীকা

[^1]: দাশগুপ্ত, শ্যামাচরণ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (মধ্যযুগ), কলকাতা: সংস্কৃত পাবলিশার্স, ১৯৮৪, পৃ. ৪৩-৫২।
[^2]: সেন, সুকুমার। পাঠভেদ ও পাঠশুদ্ধি: চণ্ডীমঙ্গলের পাঠসমস্যা, মিডিয়াভিউ পত্রিকা, ১৯৯২, সংখ্যা ৩।
[^3]: গুহ, রমাপদ। চৈতন্য সাহিত্য: পাঠ ও পাঠপ্রভেদ, শান্তিনিকেতন: বিশ্বভারতী, ২০০১, পৃ. ১০৯-১২১।
[^4]: "Digital Manuscript Library Initiative", Visva-Bharati Archives, www.visvabharati.ac.in (প্রবেশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫)।

Comments

    Please login to post comment. Login