Posts

গল্প

সামু ভাইয়ের গাড়ি

April 13, 2025

আখতারুজ্জামান নিশান

87
View

১.
সামু ভাইকে যারা চেনেন না তাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই সামু ভাই? সামু ভাইয়ের পরিচয় দিতে গেলে কয়েক হাজার পৃষ্ঠা চলে যাবে। এই কথা আমাদের না, সামু ভাইয়ের নিজের মুখের কথা। আমরা অবশ্য ভিন্ন মত পোষণ করি। তবে সেটা স্বীকার করি না তার সামনে।

সামু ভাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে বিশেষ কিছু বলতে হবে না। অল্প কয়েকটি বিশেষণে সবার মনে পরিষ্কার ধারণা হয়ে যাবে, কে এই সামু ভাই?

সামু ভাই হচ্ছেন সবজান্তা! ঘরে বসে হাতি-ঘোড়া মারেন! যার বিশ্বাস তিনি না থাকলে এই পৃথিবীর বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেত! তিনি অনেকটা কবিতার ‘নন্দলাল’ যে শুয়ে-বসে দেশ উদ্ধার করে ফেলতে বদ্ধপরিকর। এর বাইরে চিকন, লিকলিকে, লম্বা শরীরে তাকে দেখতে অনেকটা কৌতুক অভিনেতা টেলিসামাদের মতো মনে হয়। কিন্তু সামু ভাইয়ের ধারণা তিনি হলিউড অভিনেতা টমক্রুজ-এর চেয়েও একটু বেশি সুন্দর!

আমাদের কয়েকজন অর্থাৎ আমি, ইবু, শাওন, আবির আর হাসান- এদের নিয়েই সামু ভাইয়ের গ্রুপ ‘সামু অ্যান্ড ব্রাদার্স’। সামু ভাই নিজেই এর প্রতিষ্ঠাতা, নিজেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক। আমরা শুধু তার কর্মী।

২.
সামু ভাইয়ের আসল নাম হচ্ছে সামাদ। তিনি নিজেই নিজের নাম স্টাইল করে রেখেছেন সামু। যেদিন অরণি আপু তার নাম শুনে হেসে বলেছিলেন, ‘সামাদ তো পুরনো আমলের নাম!’ এটা অবশ্য অন্য গল্প। আরেকদিন বলা যাবে। আজ বরং সামু ভাইয়ের গাড়ি কেনার গল্প শুনুন।

সামু ভাই একদিন হুট করেই ঘোষণা দিলেন গাড়ি কিনবেন। এটা শুনে বোকা হাসান আরেকটু হলে বিষম খেয়ে চায়ের কাপ ফেলে দেয় আর কী! আমরা যে ধাক্কা খাইনি তা নয়। তবু সামলে নেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু হাসানের বিষম খাওয়া দেখে সামু ভাই তার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কী রে, এভাবে আঁতকে উঠলি যে? তোদের কি ধারণা এই সামু গাড়ি কিনতে পারে না?’

আমি কিছুটা মিনমিনে গলায় বললাম, ‘না ভাই, তা কেন হবে? আপনি যেহেতু কিনবেন বলেছেন সেহেতু আপনার গাড়ি কেনার নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।’

সামু ভাই তার চিন্তাকে সমর্থন করেছি এটা ভেবে কিছুটা খুশি হলেন।

বললেন, ‘ইয়েস, আমি চিন্তা করে দেখলাম, আমি একটা গ্রুপের লিডার। এলাকার অনেক কাজ আমাকে করতে হয়। তোরা তো জানিস। এখন একটা গাড়ি না হলে হচ্ছে না। তোদের ইজ্জতের কথাও ভাবতে হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম গাড়িটা কেনার।’

সামু ভাইয়ের গাড়ি কেনার সঙ্গে আমাদের ইজ্জতের কী সম্পর্ক সেটা বুঝতে পারলাম না। তবু এই প্রশ্ন তাকে করা যাবে না। তিনি যা বলবেন তাই সঠিক। ইবু জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, কী গাড়ি কিনবেন?’

সামু ভাই বললেন, ‘একটা মাইক্রো। হায়েস সুপার জি এল একটা।’

হাসান বলল, ‘ভাই, এত দামি গাড়ি? টাকা কই পাবেন?’

সামু ভাই বিরক্ত হলেন। তার কথার মাঝখানে কথা বলা নিষেধ। বললেন, ‘কথা শেষ না করলে কীভাবে বুঝবি মাথা মোটা?’

‘বলছি, হায়েস এর দাম বেশি। তাই আপাতত মামার একটা পুরনো মাইক্রো আছে সেটা নিয়ে আসব।’

বললাম, ‘ভাই, তিনি দেবেন?’

‘দেবে না কেন? ভাগিনা আবদার করলে কেউ ফেলে দেয় রে ব্যাটা?’

৩.
কয়েকদিন পরের কথা।বিকালের দিকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ছুটে গেল। আর রাস্তার দিকে কালো ধোঁয়া দেখে ভয় পেয়ে বের হলাম বাসা থেকে। দেখি সামু ভাইয়ের বাসার ওদিক থেকেই ধোঁয়া আসছে। আমি, ইবু, আবির আর হাসান দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি সামু ভাই কয়েকশ বছর আগের একটা গাড়ির কাচ মুছছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, ‘যাক, তোরা এসে গেছিস। বলেছিলাম না, মামা চাইলেই দিয়ে দেবেন।’

বুঝলাম শব্দ আর ধোঁয়ার কারণ। গাড়ির কন্ডিশন দেখে আমি মনে মনে ভাবলাম, যে গাড়ি! মামা আপদ বিদায় করেছেন। এই গাড়ি বিক্রি করতে গেলে মামাকে উলটো ক্রেতার হাতে টাকা গুঁজে দিতে হতো!

আমি বললাম, ‘ভাই, গাড়ির তো এন্টিক ভ্যালু অনেক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলের হবে শিওর।’

সামু ভাই বললেন, ‘মজা করবি না একদম। ফাজিল!’

আবির বলল, ‘ভাই, গাড়ি আনলেন, ড্রাইভার কই?’

সামু ভাই বললেন, ‘ড্রাইভার ম্যানেজ করতে হবে। তবে নিজেরা শিখে নিলে আর ড্রাইভার লাগবে কেন?’

অবশ্য এ ছাড়া আর উপায় কী! যে গাড়ি, ডবল বেতন দিলেও কোনো ড্রাইভার এমন গাড়ির ড্রাইভার হতে রাজি হবে না। সেদিন থেকে সামু ভাই ড্রাইভিং শেখা শুরু করলেন।

৪.
দিন কয়েক বাদে একদিন বললেন, ‘চল, গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসি।'
সামু ভাইয়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়া মানে বিপদে পড়া। অতীতের অভিজ্ঞতায় না যাওয়াই উচিত তবু তাকে নিষেধ করা গেল না।

দিন তারিখ ঠিক করে বের হলাম। চালকের আসনে সামু ভাই। পাশের সিটে আমি। পেছনে ইবু, আবির, হাসান। হাসানের চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভয়ে ছেলেটা চুপসে গেছে। আবির দোয়া-কালাম পড়ছে। যাই হোক, দশ বারো বারের চেষ্টায় গাড়ির ইঞ্জিন  স্টার্ট হল।

গাড়িটা বাইর থেকে যা দেখা যায়, ভেতরে বসার পর বুঝতে পারলাম এর অবস্থা তারচেয়েও খারাপ। সিটে বসার পর মনে হল নিচে ফোম নেই, সব লোহা। গাড়ির গতি যত বাড়ে তারচেয়ে বেশি শব্দে গাড়ির স্ক্রুগুলো নড়ে ওঠে। মনে হয় খুলে যাবে। এটা দেখে হাসান বলল, ‘ভাই, খুলে যাবে না তো আবার?’

সামু ভাই চোখ বড় করে সামনের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন, ‘চুপচাপ বস।’

সামু ভাইয়ের স্টিয়ারিং ধরা দেখে বিপদ আঁচ করতে পারলাম। একবার ভাবি, লাফ দিয়ে নেমে যাই। 
গাড়ি মোটামুটি গতিতে ছুটছে।পেছনে তাকাতেই দেখি ইবু গাড়ির দরজা ধরে বসে আছে। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় ঝাঁপ দেবে!

জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী রে, দরজা ধরে আছিস কেন?’

ইবু বলল, ‘ওভারটেক করতে গেলে পাশের গাড়ির বাতাসে এই গাড়ির দরজা খুলে যায়।’

এটা শুনে ভয়ে ভয়ে সামু ভাইকে বললাম, ‘ভাই, আমরা বাসায় ফিরতে পারব তো? আপনি কি পুরোপুরিভাবে চালানো শিখেছেন?’

সামু ভাই বলল, ‘হুঁ। আর কয়েকদিন চালালে পোক্ত হয়ে যাব। দেখিস না, আজকে ভয় দূর করতে এলাম। ব্রেকটা ঠিকমতো কাজ করলেই হয়। এটা আবার মাঝে মাঝে কাজ করে না!’

তার ভয় দূর করতে গিয়ে যে আমাদের পটোল তোলার অবস্থা তাকে কে বোঝাবে? সেদিন বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। ঘটেনি বলে বেঁচে আছি। তবে দুর্ঘটনা ঘটেছে এলাকার কাছাকাছি আসতেই। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরো এক কিলোমিটার আমাদের ধাক্কা দিয়ে আনতে হয়েছিল।

তারপর আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই গাড়িতে আর উঠব না। আমাদের অবশ্য উঠতে হয়নি। কারণ, তার দিন দুই পরে, গাড়ি চালাতে গিয়ে সামু ভাই তার বাবার সাইকেলটা গুঁড়া করে ফেলেছেন। ফলাফল গাড়ির দরজায় সাইকেল তালা ঝুলিয়ে দেয়া হল। আমরা শুনে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম।

Comments

    Please login to post comment. Login

  • গল্পটা ভালো লাগলে মন্তব্যর ঘরে জানাবেন। আপনাদের যেকোন গঠনমূলক মন্তব্য আমাকে লিখতে সাহায্য করবে!