দাদি’র কথা শুনে পুরো ভেন্যু যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
সবাই তাকিয়ে রইলো—এই বয়সী মহিলা কী সাহসিকতায় এই কথা বললেন! আর মিস্টার আমান… সে যেন আচমকা একটা ঝড়ের মধ্যে পড়ে গেছে।
তৃষার মুখ আরও বেশি ফ্যাকাশে, তার চোখ দুটো কাঁপছে—এই অপমানের মধ্যেও যেন এই প্রস্তাবটা তার হৃদয়কে আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে।
মিস্টার আমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।
তার মাথার ভেতর যেন অনেকগুলো চিন্তার ধাক্কা খাচ্ছে—
"দাদি কি সত্যিই এটা বলতে পারলেন? আমি কি রাজি হবো? এটা কি কর্পোরেট দায়িত্ব, না ব্যক্তিগত কিছু?"
কিন্তু তার চোখ বারবার তৃষার মুখে গিয়ে আটকে যাচ্ছিল।
এই মেয়ে, যার চোখে এখনো অশ্রু নেই—কিন্তু বুকের ভেতরটা নিঃশব্দে ভেঙে যাচ্ছে।
তখন আমান বললো—
“দাদি… আপনি যেটা বলেছেন সেটা অনেক বড় কথা। আমি সম্মান করি আপনার সিদ্ধান্ত। কিন্তু…”
তার গলা একটুখানি থেমে গেল। সবার দৃষ্টি ওর দিকেই।
“এই সিদ্ধান্ত শুধু আমার নয়, এই মেয়েটারও। ওর অনুমতি ছাড়া আমি এক কদমও এগোবো না।”
সবার চোখ এখন তৃষার দিকে।
তৃষার চাচা তখন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“সবাই একটু শান্ত হন… আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই।”
তার গলায় ক্লান্তি, বিরক্তি, আর সম্মানের ভার একসাথে বাজছিল।
“আরিয়ান ছেলে ভালো, আমরা সবাই জানি। এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণে। তাই আমি বলছি—এখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে, আমরা রাত ১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এটা শুধু তৃষার জন্য নয়, আরিয়ানের সম্মানের জন্যও। আমরা এমন মানুষ না যে কথায় কথায় সম্পর্ক ভেঙে ফেলি।”
সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
তৃষার বাবা কৃতজ্ঞ চোখে তাকান তার ভাইয়ের দিকে।
তৃষা কিছু বলেনা, শুধু ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
আমান এক কোণে দাঁড়িয়ে, যেন নিজেই বোঝার চেষ্টা করছে—এটা কাকতালীয় নাকি কোনো ভাগ্যচক্র?
মঞ্চের উপরে ফুল, আলো, অতিথিদের কথাবার্তা—সব কিছু এখন যেন থমকে গেছে।
রাত ১০টা—এই সময়ের মধ্যে কি ফিরবে আরিয়ান?
নাকি এক নতুন সম্পর্কের সূচনা হবে—ভবিষ্যতের এক অজানা পথে…
ঘড়ির কাঁটা একটানা এগিয়ে চলেছে।
রাত আটটা… আটটা পঁচিশ… আটটা পঁয়ত্রিশ…
আত্মীয়স্বজনদের মুখে মুখে এখন শুধুই কানাঘুষা।
— “ছেলে এমন করলে তো মেয়ের জীবন শেষ।”
— “বলেছিলাম না? মেয়েটার এত অহংকার, এবার বুঝুক।”
— “এতো বড়দিন, অথচ বরই নেই—কি লজ্জা…”
অনেক অতিথি বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করলো।
মঞ্চের আলো যেন ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে।
তৃষা চুপচাপ বসে আছে।
চোখে নেই একফোঁটা জল।
নেই কোনো অভিমান, নেই কোনো রাগ, নেই কোনো আর্তনাদ।
কিন্তু যেটা আছে… সেটা একটা ভয়ানক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।
একটা ঘন বিষাদ যেন তার চারপাশ ঘিরে ধরেছে।
একটা অচেনা শূন্যতা, যেটা কাউকে দোষ দেয় না—শুধু নিঃশব্দে সমস্ত স্বপ্নগুলো গিলে ফেলে।
এ দৃশ্যটা দেখে আমান এর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
এমন নিরবতা কোনোদিন দেখে নি সে।
তৃষার এই চেহারা—যেন শত শত শব্দ চিৎকার করছে তার ভেতরে, অথচ বাইরে একফোঁটা শব্দ নেই।
"কি অদ্ভুত মেয়ে..." মনে মনে ভাবলো আমান।
"এমন বুকে এত কষ্ট নিয়েও মুখে একটাও অভিযোগ নেই।"
তার দাদি পাশে এসে ফিসফিস করে বললেন,
“তোমার যদি কিছু বলার থাকে, এখনই সময়…”
চলবে........