Posts

চিন্তা

সংস্কৃতির রাজনীতিকীকরণ ও বর্ষবরণ

April 14, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

171
View

বৈশাখ আয়োজনে আগেও আমরা ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি দেখেছি। সংস্কৃতির একপাক্ষিক ন্যারেটিভ শুনেছি। তবে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা কি এবার চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক হয়ে উঠল? কথা উঠছে, একসময়ের মিলনের উৎসব এখন যেন পরিণত হচ্ছে মতাদর্শিক ময়দানে, যেখানে ‘শিল্প’ হয়ে উঠছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবার শাণিত অস্ত্র, আর ‘উৎসব’ হয়ে উঠছে প্রোপাগান্ডার বাহন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে আয়োজিত এই বর্ষবরণ শোভাযাত্রা, যেটি আগে 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' নামে পরিচিত ছিল, ২০১৬ সাল থেকে ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃত; সেটি এবার নতুন নামে হাজির—'বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা'। চারুকলার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক শিক্ষকদের বলয়ে নিয়ে গিয়ে ওই নামবদলেই বিতর্কের সূত্রপাত। তারপর একে একে উন্মোচিত হয়েছে রাজনৈতিক ইঙ্গিতময় মোটিফ, মুখাবয়ব, ব্যঙ্গচিত্র এবং প্রতিহিংসার প্রতিচ্ছবি।

বিশেষত, শোভাযাত্রায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতীকী চিত্র হিসেবে যেই মোটিফ ব্যবহৃত হয়েছে, তা দেখে অনেকেই বলছেন, সেটির মুখাবয়ব স্পষ্টতই সাবেক একনায়ক শেখ হাসিনার সঙ্গে মিলে যায়। এই অভিযোগ উড়িয়ে না দিয়ে বরং শিল্পের স্বাধীনতা ও ‘ফ্যাসিস্ট প্রতিচ্ছবি’র কথা বলে সেটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, 'এই শোভাযাত্রা রাজনৈতিক নয়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে।'

এই বক্তব্য নিছক ‘কূটনৈতিক বুলি’ নয়, এটি সাংস্কৃতিক উচ্চাসনের নামে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এক রূপক নাট্যশালার গন্ধ বহন করে। আয়োজকরাই যেখানে নেপথ্য পরিচালক, আবার নির্লজ্জভাবে দাবি করেন ‘আমরা রাজনীতি করছি না’—তখন সেটিকে হিপোক্রিসির চূড়ান্ত প্রকাশ ছাড়া আর কী বলা যায়?

যাঁরা একসময় মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সরকারি প্রচারযন্ত্র বলে সমালোচনা করতেন, আজ তাঁরাই সেই একই মঞ্চে রাজনৈতিক বার্তা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের সুবিধার্থে। তখনকার শাসকদের প্রপাগান্ডা যাদের চোখে লাগতো, আজ তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছেন আরেক শাসকের ছায়া। মুখোশ পাল্টেছে, কিন্তু কৌশল তো একই রয়ে গেছে।

এই বর্ষবরণ শোভাযাত্রায় থাকা মোটিফের তালিকায় চোখ রাখলেই বোঝা যায় এর রাজনৈতিক বার্তা কতটা সুপরিকল্পিত ও সুস্পষ্ট। ৩৬ জুলাইয়ের টাইপোগ্রাফি, মুগ্ধ হত্যার প্রতীক, ফ্যাসিবাদী মুখাকৃতি—সব মিলিয়ে যেন এক রাজনৈতিক কোলাজ। এখানে নেই নির্ভেজাল লোকজ আনন্দ, নেই বৈচিত্র্যপ্রীতির নিরপেক্ষ চর্চা। আছে শুধু রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আর সংস্কৃতির মোড়কে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার নির্মম নকশা। বছরের প্রথম দিনে নির্মল আনন্দের সাথে যার ভীষণ ফারাক।

রঙিন বর্ষবরণ আজ পরিণত হলো প্রতিশোধের ক্যানভাসে। চারুকলার মোটিফে এখন আর আনন্দ নয়, ফুটে ওঠল প্রতিপক্ষকে অপমান করার সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ। এই ‘শিল্প’ আসলে পরিণত হয়েছে ‘রাজনৈতিক বিদ্বেষের চিত্রশালা’তে।

এমনকি এবার শেখ হাসিনার প্রতিচ্ছবি নিয়ে বিতর্ক উঠতেই আগুনে পোড়ানো হয় ওই মোটিফ। তারপর ফের নতুন মোটিফ বানিয়ে এগিয়ে যায় শোভাযাত্রা। পাল্টা প্রচারণায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মুখাবয়ব নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা ব্যঙ্গচিত্র। এই প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে, বর্ষবরণের শোভাযাত্রা এখন আর কারও সম্প্রীতির উৎসব নয়, বরং ঘৃণা বিপণনের নতুন মঞ্চ।

যাঁরা নিজেরাই অতীতে রাজপথে দাঁড়িয়ে সরকারের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে গলা তুলেছেন, তাঁরাই আজ উৎসবের নাম করে সেই একই অসূয়াকে শৈল্পিক মুখোশ পরিয়ে হাজির করছেন। চারুকলার কলাকুশলীরা এখন আর যেন শুধু শিল্পী নন, তাঁরা হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক প্রচারক, ক্যানভাস এখন আর রঙের নয়—বরং প্রতিহিংসার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে যেমনটি বলেছেন, 'সংস্কৃতি কখনোই রাজনীতি থেকে আলাদা নয়। কিন্তু তাই বলে সংস্কৃতিকে রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর দায় এড়ানো যায় না। বর্ষবরণের মতো সার্বজনীন উৎসব যদি একপক্ষের দখলে চলে যায়, তবে বিভাজন শুধু অবশ্যম্ভাবীই নয়, তা উৎসবের চেতনাকে ধ্বংস করে দেবে।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে এম শাহনেওয়াজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, 'এখন যা হচ্ছে তা ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার ফল। বর্ষবরণ সম্পর্কে না জানার প্রতিফল। যাদের হাতে সাংস্কৃতিক উৎসব, তাদের নিজস্ব আদর্শ না থাকায় শাসকদলের সুবিধামতো সেটি বদলে যাচ্ছে।' তাঁর বক্তব্যে আশার আলোও রয়েছে—তিনি বলেন, 'সংকট থাকবে, তবে সময়ের ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে উৎসব তার আপন মহিমায় ফিরে আসবে।'

তবে আদৌ কি এই আশা বাস্তব হবে? নাকি উৎসব আর সংস্কৃতি একদিন পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রচারণার ব্যানারে হারিয়ে যাবে?

দায় স্বীকার, ক্ষমা, রিকনসিলিয়েশন, অনুশোচনার আলাপ ভুলে ক্রমাগত ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা এই জাতিকে নিশ্চিতার্থেই ঘৃণার বাইনারিতে ফেলে দেবে। এখান থেকে সরে আসতে হয়ত কয়েক প্রজন্মকে ভয়াল কোনো অপশক্তির সাথে যুদ্ধ করা লাগতে পারে।

পহেলা বৈশাখের যে আবহমান চেতনা—ভিন্নমতের সহাবস্থান, মিলন আর সার্বজনীনতাকে ধারণ করা—তা আজ হুমকির মুখে পড়ল। যদি এই রাজনীতিকীকরণ চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যতে বর্ষবরণ আর ‘আনন্দ’ শোভাযাত্রা নয়, বরং হবে ‘বিতর্ক’ শোভাযাত্রা। আর তার সামনে থাকবে কোনো না কোনো মুখাবয়ব—যার পেছনে থাকবে রঙিন প্রতিশোধ আর শিল্পের নামে অজুত প্রোপাগান্ডা।

লেখক: সাংবাদিক 
১ বৈশাখ ২০২৫ | ১৪ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login