~ ইরা, নিজের হাতে সব শেষ করে দিলি? নিজের বাবাকে নিজে খুন করে ফেললি? হাত কাঁপলো না একবারও?
আকুল কণ্ঠে কথাগুলো বলে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লেন অনামিকা বেগম। চোখের সামনে নিজের মেয়ের হাতে রক্তাক্ত ছুড়ি দেখে ঘাবড়ে গেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে পিছনে নিজের স্বামীর রক্তাক্ত লাশ দেখে সেখানেই বসে পড়েন। মাথা কাজ করছে না তার। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। মাকে এভাবে পড়ে যেতে দেখে দৌড়ে আসে ইরা। ভীত কণ্ঠে বলে উঠে,
- মা, তোমার কিভাবে মনে হলো আমি বাবাকে....
প্লিজ মা, উঠো! বাবার কিচ্ছু হয়নি, চলো হসপিটালে চলো।
অনামিকা বেগমকে উঠতে না দেখে হন্তদন্ত পায়ে দৌড়ে গেলো বাড়ির দারোয়ান কাকা মান্নান কে ডাকতে। যত জোরে পারলো চিল্লিয়ে ডেকে আনলো। নিজের মালিককে এভাবে দেখে দ্রুত কল করলো তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে। প্রায় দশ থেকে পনেরো মিনিট পরে হন্তদন্ত পায়ে আসলো মানিক সাহেব। ইরার বাবাকে ততক্ষনে মান্নান মিয়া ও ইরা মিলে বেড এ শুইয়ে দিয়েছে। মানিক সাহেব ইরার বাবার পালস চেক করে বুঝলো তিনি আর নেই। সেদিন বাবার লাশটাও আর দেখতে দেয়নি তার মা। কী থেকে কী হয়ে গেছিলো ইরা এখনো জানেনা। সবাই মিলে ইরাকে বাধ্য করেছিলো এটা ভাবতে যে সেই ইরার বাবার খুনি। আনমনে এক প্রহর আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠে ইরা। আজও সেই দিনটার কথা ভাবলেই ইরার গা শিউরে উঠে। সে হারিয়েছে তার বাবাকে, সে হারিয়েছে তার মাথার উপর থাকা ছায়াকে। সেদিন সে সব হারিয়েছে, সব। এরপর একটা দিনও ভালো কাটেনি ইরার। মাত্র ১৭ বছর বয়সের ইরা আজ অনেক বাস্তবতার সম্মুখীন। বাস্তবতার ভাড়ে নুইয়ে পড়া মেয়েটার কষ্ট হয় কী? হয়তো না!! কিন্তু সেদিন ইরা দেখেছিলো এক ভয়ঙ্কর সত্যি। যে সত্যিটা কেউ জানে না, সেদিন মূলত বাবাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে দিশা হারিয়ে ফেলেছিলো ইরা, বাবার শরীরে ছুড়ি দেখে সেটাই টেনে বের করেছিলো ইরা যাতে বাবার কষ্ট একটু হলেও কমে। কী করবে ভেবে না পেয়ে দৌড়ে ছুট লাগায় বাড়ির বাইরে, তখন সে দেখতে পায় কালো কোর্ট পড়া কয়েকজন লোক! একজন লোককে সবাই ' আয়াজ ভাই ' বলে সম্মোধন করছিলো। সেইই ' আয়াজ ভাই ' এর লোকরাই যে তার বাবাকে খুন করেছে এটা নিয়েই সন্দেহের শেষ নেই ইরার।এসব ভাবতে ভাবতেই ডাক পরে অনামিকা বেগমের।
- ইরা, ইরা! সেই কখন ছাদে গিয়েছিস কাপড়গুলো আনতে! এখনো আনিস নি?
ইরার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অনামিকা বেগম ছাদে ছুটে আসে, বৃষ্টি পড়ছে তবুও মেয়েটা নিচে এলোনা। কী হলো আবার!
ছাদে পা রাখতেই দেখতে পায় একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ইরাকে। হালকা হাতে ধাক্কা দিতেই চমকে উঠে ইরা। গায়ে প্রচন্ড জ্বর, তবুও বৃষ্টিতে ভিজছে। হু হু করে বাতাস আসছে পূর্বদিক থেকে! প্রচন্ড গর্জনেও বাজ পড়ছে যেনো আকাশও বাধা মানছে না আজ নিজের রাগ প্রকাশে! ইরার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ইরাকে নিয়ে নিচে চলে গেলেন অনামিকা বেগম। ততক্ষনে ইরা বসে পড়েছে নিজের বিছানায়। ইরার রুমে গিয়ে লাইট অন করে ইরার পাশে বসলেন কিছুক্ষন, কিন্তু ইরার কোনো ভাবান্তর নেই। ইরার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,
- যা করার করে ফেলেছো আজ থেকে প্রায় পনেরো দিন আগে, এখন এটা নিয়ে নাটক করে কী লাভ? যে মেয়ের বাবাকে মেরে ফেলতে হাত কাঁপেনি সে মেয়ের এসব নাটক মানায় না! নাকি তুমি সেই ছেলের জন্য তোমার বাবার জীবনটাই নিয়ে নিলে?
প্রচন্ড ঝাঁকানিতে কেঁপে উঠলো ইরা। ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
- কোন ছেলে মা? কিসের কথা বলছো তুমি? ও শুধু আমার কলেজের বন্ধু ছিলো । আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। বাবার সাথে সেদিন আমার এসব নিয়ে কোনো ঝামেলা হয়নি। বাবা আর আমার মধ্যে আমার রেজাল্ট নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো! তুমি জানোই সব তবুও কেন একই কথা বার বার বলো , মা?
অনামিকা বেগম ফুঁসে উঠলো যেনো মেয়ের কথায়।
- তাহলে সেদিন কেনো শুনতে হলো আমার আকাশের কাছ থেকে যে তোমরা একে অপরকে বিয়ে করতে চাও আর এটা নিয়েই তুমি তোমার বাবাকে মানাতে গিয়েছিলে?
ইরা এবার নীরব হয়ে গেলো! সত্যি তো কোনো উত্তর নেই তার কাছে। আকাশ কেন সেদিন এসব বলেছিলো ইরার জানা নেই। এতটাই দিশেহারা ছিলো ইরা জিজ্ঞেস করাও হয়নি। হবেই বা কিভাবে? সে তো এরপরে কলেজই যায়নি। তবে তার জানতে হবে কেন বলেছিলো এই চরম মিথ্যাটা!
-শুনো মেয়ে, কোনো ইন্টার এ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে কোনো অভিভাবক এটা মেনে নেবে না? তোমাদের সাহস কিভাবে হয়েছিলো এসব বলার?
ইরার এখন মনে হচ্ছে তার মা নির্বোধ এর মতো কথা বলছে। সে তার মা কে অনেকবার বলেছে সেদিন সে কিছুই করেনি, বরং সেই সত্যিটা বলেছে যেটা আসলে ঘটেছে। কিন্তু ইরার মা বিশ্বাস করেনি, নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করেনি! ইরা ভেবে পায়না মায়ের হঠাৎ হলো কী, আর সে কী আসলেই এসব দেখেছিলো নাকি নিজেই বাবার বুকে ছুড়ি চালিয়েছিলো এসব উল্টাপাল্টা ভেবেই যেনো ইরা ক্লান্ত। বাবার বুঁকের ছুড়িটার কথা মনে পড়লেই ইরার বুক কেঁপে উঠে। সবচেয়ে বড় কথা সেদিন এর পর থেকে তার নিজের ইয়াশ কেন নিখোঁজ! ইয়াশ এর মুখে শুনেছিলো সে আয়াজ ভাই এর কথা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। ইরা বুঝতে পারে না একজন রাজনীতিবিদ এর সাথে বাবার কিসের লেনাদেনা ছিলো যে খুন হতে হলো?
চলবে?
সূচনা পর্ব