Posts

চিন্তা

বর্ষবরণে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুপস্থিতি ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা

April 15, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

171
View

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে বাংলা একাডেমির ক্যালেন্ডার ফলো করবার সুযোগ রাখা হয়নি। সে হিসাবে গতকাল ছিল তাদের চৈত্র সংক্রান্তি। অধিকাংশ হিন্দু বাড়িতে তিতা ও নিরামিষ সব খাবার খাওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও সুযোগমতো আয়োজন করা হয়েছিল চড়কপূজার। তারমানে ইনক্লুসিভ আয়োজনের গল্প শোনা‌ গেলেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য গতকাল নববর্ষ ছিল না।

তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রাম কিংবা দেশের অপরাপর জেলার নৃগোষ্ঠীরা আলাদা সময়ে বর্ষবরণ উদযাপন করে থাকে। চাকমাদের বিজু, মারমাদের সাংগ্রাই কিংবা গারোদেরট ওয়াংগালার সাথে ১৪ এপ্রিলের বর্ষবরণের মিল নাও থাকতে পারে। তবু তাদেরকে গোষ্ঠীগতভাবে ডেকে এনে বর্ষবরণে শামিল করা হয়েছে। হিন্দুরা কি তাদের সংক্রান্তির রিচুয়াল রেখে বর্ষবরণের আনন্দে মাততে পেরেছিলেন?

দেখাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে নতুন বছর আসে, আবার যেন আসেও না। বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেবনিকেশে বছর ঘোরে, অথচ মনোযোগের এক প্রান্তে থেকে যায় এক প্রান্তিক উদাসীনতা। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে ঢাকঢোল পিটিয়ে যখন পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়, তখন দেশের প্রায় তিন কোটি হিন্দু নাগরিক নিরুত্তাপ চৈত্র সংক্রান্তি পালন করে থাকেন। এই সাংস্কৃতিক ছাঁকনিতে ধরা পড়ে না তাঁদের লাল-সাদা শাড়ি, ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা মঙ্গল বা হালের আনন্দ শোভাযাত্রার পদচারণা। বর্ষবরণের উৎসব তখন হয়ে ওঠে একচ্ছত্র, আংশিক ও অপ্রতিফলিত গণচেতনা।

বাংলা বর্ষপঞ্জির এই দ্বৈততা হঠাৎ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো আঘাত করেনি, বরং এটি এসেছে এক সুপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে। ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি বঙ্গাব্দের পঞ্জিকা সংস্কার করে একে 'স্থির পঞ্জিকায়' রূপ দেয়। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা হয়। যেমন—১৪ এপ্রিল হবে পহেলা বৈশাখ, ১৫ জুন আষাঢ়ের প্রথম দিন ইত্যাদি।

বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্বে সর্বদাই নেতৃত্বে ছিল বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ নামে একটি কমিটি গঠন করে।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পণ্ডিত ব্যক্তি হয়েও, তার থেকে ভিন্ন পরিমণ্ডলের বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা ছিল অ্যাস্ট্রোনমির বিষয়। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে করা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’ কমিটির সুপারিশ কোনো সরকারই কার্যকর করেনি।

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, পাকিস্তান আমলে করা সংস্কারকৃত পঞ্জিকা যা এতকাল খাতাবন্দি ছিল, সেই পঞ্জিকাকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিলে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়।

অনেক বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও বাংলা পঞ্জিকা বিষয়ে এরশাদ সরকার, খালেদা জিয়া সরকার ও শেখ হাসিনা সরকার একই পথে হেঁটেছে। বর্তমানে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সরকারও পূর্ববর্তী বিভাজিত ধারণার বাইরে আসতে পারেননি।

আগে যা ছিল আকাশপানে তাকিয়ে সময়ের সন্ধান, এরশাদ তা পরিণত করেন ক্যালেন্ডারের পাতায় ছাপানো নির্ধারিত একপাক্ষিক সিদ্ধান্তে। কিন্তু সমস্যা হলো, হিন্দু ধর্মীয় জীবনের দিনলিপি চলে অন্য এক স্রোতে—সেই স্রোতের নাম সুর্যসিদ্ধান্ত। হিন্দু পঞ্জিকা চাঁদের অবস্থান ও সূর্যের গতি অনুযায়ী চলমান এক জ্যোতির্বিদ্যাভিত্তিক ক্যালেন্ডার। বাংলা একাডেমির 'স্থির পঞ্জিকা' থেকে তা একদিন পিছিয়ে থাকে, কিংবা এগিয়ে। ফলে রাষ্ট্র যখন বৈশাখে পা রাখে, তখন হিন্দু গৃহে বাজে চৈত্র সংক্রান্তির বিষাদ বীণা। উৎসব ও নিরামিষের ভিন্ন ব্যাকরণে বিভ্রান্ত হয় বাংলার আবহমান ঐকতানিক চেতনা।

এই অবস্থাকে অনেকে সামান্য তফাত বলেই এড়িয়ে যান। কিন্তু এই সামান্য তফাতে লুকিয়ে থাকে বৃহত্তর এক সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। নববর্ষ এমন এক দিন, যেদিন সব সম্প্রদায়, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মিলেমিশে ভবিষ্যতের দিকে একসঙ্গে পথচলার শপথ নেয়। অথচ এখন সেই দিনটিতেই দেশের একটি অন্যতম ধর্মীয় সম্প্রদায় আনুষ্ঠানিকভাবে থাকে অনুপস্থিত।

এই দ্বন্দ্বের সমাধান কোথায়? সমাধান লুকিয়ে আছে ঐক্যের প্রয়াসে, প্রাধান্যের রাজনীতিতে নয়। ভারতের মতো দেশে যেমন কেন্দ্রীয় হিন্দু ক্যালেন্ডার বোর্ড রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশেও একটি সর্বদলীয় পঞ্জিকা সমন্বয় পর্ষদ গঠন করা যেতে পারে। যেখানে থাকবে বাংলা একাডেমির গবেষক, হিন্দু ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ। বাংলা ক্যালেন্ডারকে ধর্মীয় ও নাগরিক দুই ভূমিকায় ব্যবহারের পথ খুঁজে নিতে হবে। যেমন—প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক ধরনের পঞ্জিকা, আর ধর্মীয় অনুশীলনে আরেক ধরনের। অথবা দুটোকেই বিজ্ঞানভিত্তিক যূথবদ্ধতায় গ্রন্থিত করা যেতে পারে।

বাংলা নববর্ষ কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের নয়, এটি একটি ভূখণ্ডের আত্মপরিচয়। সেই আত্মপরিচয়ে যদি কারও  অনুপস্থিতি থাকে, তবে তা নিছক ক্যালেন্ডারের ভুল নয়, বরং সমাজের এক অবচেতন বিদ্রূপ। রাষ্ট্র যদি সত্যিই চায় ‘সবার জন্য উৎসব’—তবে সময় এসেছে এই সাংস্কৃতিক ফাঁকফোকর বন্ধ করার।

কেননা দিন যায়, বছর ঘোরে। কিন্তু একটি জাতির বিবেক যদি একই জায়গায় স্থির থাকে, তবে কোনো ক্যালেন্ডারই তাকে এগিয়ে নিতে পারে না।

একটি রাষ্ট্রীয় উৎসবে দেশের একটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ না থাকা একধরনের সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা। ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকার এই অসম্পর্ক শুধুই জ্যোতির্বিজ্ঞানের নয়—এটি সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তিরও বিষয়। রাষ্ট্র যদি সত্যিই সবাইকে নিয়ে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐক্য গড়ে তুলতে চায়, তবে সময় এসেছে বাংলা বর্ষপঞ্জিকায় ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ খোঁজার।

লেখক: সাংবাদিক 
১৫ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login