চারদিকে কুয়াশার ঘনত্ব এতটাই, যেন বাতাসেও কিছু লুকিয়ে আছে। এক পা, দুই পা এগোতেই লাম আলিফ বুঝে গেল—এটা আর তার চেনা পৃথিবী নয়।
এই জায়গায় শব্দ প্রতিধ্বনি হয় না, নিজের নিঃশ্বাসও যেন নিঃশব্দ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে হঠাৎ একফোঁটা আলো দেখা গেল—একটা ভাঙা লণ্ঠন, যেটা নিজের মতো করে জ্বলছে। আলিফ সেটা হাতে নিতেই লণ্ঠনের ভেতরে এক ছায়ামূর্তি দুলে উঠল।
"তুই কি সত্যিই জানিস তুই কোথায় এসেছিস?"
আওয়াজটা যেন তার মাথার ভেতরে।
আলিফ কাঁপে না, কারণ তার মনে একটা অদ্ভুত শান্তি কাজ করছে—হয়তো এটা ছায়াদের ছলনা। সে বলে,
"আমি আমার দাদুকে খুঁজতে এসেছি। তিনি এখানেই কোথাও আছেন।"
ছায়ামূর্তি হেসে ওঠে—একটা ফাঁপা হাসি, যেখানে কোনো উষ্ণতা নেই।
"তোর দাদু গল্পকার ছিল, জানিস তো? কিন্তু সে একটা ভুল করেছিল। সে আমাদের ছায়া লিখে ফেলেছিল।"
আলিফ বিভ্রান্ত।
"মানে?"
"যে ছায়ার কথা কেউ লেখে না, তারা হারিয়ে যায়। কিন্তু যাকে কেউ লিখে ফেলে… তারা বাস্তব হয়ে ওঠে।"
আলিফের হঠাৎ মনে পড়ে যায় দাদুর ডায়েরির একটা লাইন:
"তাদের নাম নিও না… তাদের রূপ লেখো না… ছায়া যতদিন অচেনা, ততদিন নিরাপদ…"
সামনের দিকটা ধোঁয়াটে, কিন্তু হঠাৎ করে কিছু ছায়ামূর্তি দেখা যায়—তারা নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেউ কাঁদছে, কেউ হাসছে, কেউ দেওয়ালে মাথা ঠুকছে বারবার।
এরা কারা?
একটা ছায়া তার কাছে এগিয়ে আসে।
"আমি ছিলাম গল্পকার, আমিও লিখেছিলাম। এখন আমার গল্পের ছায়ারা আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে। তুই এখন সেই পথেই চলেছিস, আলিফ।"
আলিফ তখনই টের পায়—তার ছায়া… হাঁটছে উলটো দিকে। তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। আর ছায়াহীন মানুষ মানেই এই জগতে একটাই পরিণতি—তুমি আর নিজের ‘তুমি’ নও।
আর তখনই, ঘড়ির কাঁটার শব্দের মতো এক আওয়াজ…
টিক… টিক… টিক…
সময় ফুরিয়ে আসছে।
আলিফের সামনে তখন ভেসে ওঠে আরও একটা দরজা—কিন্তু এটা আগের মতো না। এর গায়ে রক্তের মতো লাল অক্ষরে লেখা:
"দ্বিতীয় সত্য—প্রত্যেক গল্পের এক খরচা আছে। তুই কতটা দিতে পারবি?"
চলবে…
আলিফকে সেই দ্বিতীয় দরজা পার করে নিয়ে যাই, যেখানে হয়তো তার দাদুর আত্মা আটকে আছে—আর হয়তো নিজের আত্মাও।