[মূল লেখাটির শিরোনাম ‘Sulla fine del mondo'; ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর agamben’s blog-এ লেখাটি প্রকাশিত হয়। বাঙলা অনুবাদ করা হয়েছে D. Alan Jean নামক জনৈক অনুবাদকের ইংরেজি অনুবাদ থেকে]
খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে ‘ইহজগতের অবসান’ প্রসঙ্গটা ঘুরেফিরে বারবার হাজির হয়েছে। প্রতিটি যুগেই আবির্ভূত হয়েছেন পয়গম্বরেরা, ঘোষণা করেছেন, ‘সমাপ্তি অতি নিকটে'। আজকের যুগের একটা অনন্য দিক হচ্ছে, যে পরলোকতাত্ত্বিক ভূমিকা থেকে চার্চ অনেক আগেই সরে এসেছে, সেই ভূমিকা এখন গ্রহণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা এখন প্রায়শই পয়গম্বর হিসেবে হাজির হচ্ছেন; জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ইহজগতের অবসান যে অনিবার্য, পরম নিশ্চয়তার সঙ্গে এই ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছেন তারা। এইটা একটা মৌলিক ব্যাপার নিশ্চয়ই, তবে এইটা বিস্ময়কর কিছু না, বিশেষত যদি আমরা মনে রাখি যে, আধুনিক চেতনায় ধর্মের জায়গা দখল করেছে বিজ্ঞান এবং কার্যত একটা ধর্মীয় ভূমিকাই পালন করছে সে। বিজ্ঞান আসলেই আমাদের এই জমানার ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ মানুষ এখন বিজ্ঞানেই বিশ্বাস করছে। কমসে কম, মানুষ বিশ্বাস করছে যে সে বিজ্ঞানে বিশ্বাস করে।
যেকোনো ধর্মের মতোই বিজ্ঞান-ধর্মেরও একটা পরলোকতত্ত্বের দরকার হয়। অর্থাৎ, এমন একটা অ্যাপারাটাসের দরকার হয়, যেটা এই ধর্মে বিশ্বাসীদের একটা সার্বক্ষণিক ভয়ের মধ্যে রাখবে ও সেই সুবাদে তাদের বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করবে, এবং একই সঙ্গে একটা বিশেষ যাজকশ্রেণীর হাতে রেখে দেবে সর্বময় ক্ষমতা। গ্রেটা থানবার্গের মতো ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব এই অবস্থাকেই নির্দেশ করছে। গ্রেটা বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বাণীগুলিতে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন, ফলে মধ্যযুগের মিলেনিয়ালিস্টরা যেমন যিশুখ্রিস্টের অত্যাসন্ন পুনরাগমনের প্রতীক্ষায় থাকতো, গ্রেটাও তেমনি ২০৩০ সাল নাগাদ ইহজগতের অবসানের অপেক্ষা করছেন। একই কথা মনে হয়, Gaia-র আবিষ্কারক সেই বিজ্ঞানীর দিকে তাকালে, যিনি খালি বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের শতকরা হার নিয়ে গবেষণা করেই অকৃত্রিম সরলতার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মানবজাতির পরিত্রাণ নিহিত রয়েছে নিউক্লিয়ার এনার্জিতে। উভয় ক্ষেত্রেই ভাববার বিষয় হচ্ছে, ইহজগতের অবসানের ব্যাপারে এই যে বাজিগুলি ধরা হচ্ছে, এগুলোর চরিত্র মূলত ধর্মীয় এবং আগাগোড়া অবৈজ্ঞানিক। ‘পরিত্রাণ’-কে কেন্দ্র করে এই যে এতো মাতামাতি, এতেই পুরো ব্যাপারটা খোলসা হয়ে যায়।
তো, এই ঘটনাটা খুবই বিরক্তিকর বিশেষত এই কারণে যে, বিজ্ঞান এর আগে কখনোই পরলোকতত্ত্বকে তার মাথা ঘামানোর জায়গা বলে মনে করেনি। এটা অবশ্য বোধগম্য যে, পয়গম্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াটা আসন্ন মহাদুর্যোগ প্রতিরোধ করার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়ারই একটা লক্ষণ। তবে যেকোনো ধর্মের মতো বিজ্ঞান-ধর্মের বিরুদ্ধেও অনেক অবিশ্বাসী ও প্রতিদ্বন্দ্বী ধর্ম (ও ধার্মিক) ক্রিয়াশীল রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, আধুনিক যুগের আরেক বড়ো ধর্ম, অর্থাৎ অর্থধর্মের (religion of money) অনুসারীদের কথা বলা যায়। অবশ্য বাহ্যত এই দুই ধর্মকে পরস্পরবিরোধী মনে হলেও এদের কিন্তু গোপন যোগসাজশ রয়েছে। তলে তলে এরা একই৷ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পুঁজির অন্তরঙ্গ মৈত্রীই তো আজকের দুনিয়ার এই সর্বনাশা অবস্থার জন্মদাতা।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার। বিজ্ঞান তার এইসব বাতচিতের মাধ্যমে কিন্তু পরিবেশ দূষণ কিংবা প্রাণীজগতের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক অবস্থার উপর উত্তরোত্তর শিল্প-বিপ্লবের ক্ষতিকর প্রভাবের ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে না। বরং, বৈজ্ঞানিক সত্যের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলা, কিংবা ‘ভবিষ্যদ্বাণী’র সঙ্গে ‘অবশ্যম্ভাবী’কে গুলিয়ে ফেলার বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা দিয়ে বিজ্ঞান মূলত একটা কাজই করতে চাইছে। সেটা হলো, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যাতে কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক অবস্থানের কিংবা রাজনৈতিক বিকল্পের দিকে যেতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা।