Posts

চিন্তা

লন্ডন বৈঠক: বিএনপি-জামায়াতের স্নায়ুযুদ্ধ ও সন্ধির প্রতীক্ষা?

April 16, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

115
View

গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের ঢেউয়ে ভেসে গেছে শেখ হাসিনার দীর্ঘকালীন শাসন। পরপর তিনবার একতরফা ও নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, দুর্নীতির পাহাড়, একদলীয় দমননীতি এবং ক্রমাগত রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে আগুন হয়ে উঠেছিল তরুণ প্রজন্ম। ফলত, ক্ষমতার মসনদ খসে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য রাজনৈতিক আশ্রয় নেন প্রতিবেশী ভারতে। দেশের হাল ধরেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার কর্ণধার নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকার গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আলাপ থাকলেও এখন তা আগামী ডিসেম্বর-জুনে গিয়ে ঠেকেছে। চূড়ান্ত রোডম্যাপ এখনো কেউ জানে না।

এমন এক উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লন্ডনে তারেক জিয়ার বাসায় এক ‘সৌজন্য বৈঠক’ আচমকা আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের এই বৈঠককে কেউ দেখছেন ‘পুরনো সহযোদ্ধাদের সৌজন্য বিনিময়’ হিসেবে, কেউবা বলছেন—এ এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সূচনা।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান গেল রাতে ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতার সাক্ষাতে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জানা যায়নি। দুই ডাক্তারের (শফিকুর রহমান ও সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহের) এই সাক্ষাৎ রাজনীতির রসায়নে নতুন কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, নাকি নিছক সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েই থাকবে, তা বুঝতে হলে আমাদের চোখ রাখতে হবে সামনের দিকে।’

যদিও বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দলের সম্পর্ক বরফশীতল, এক সময় তারা ছিল অভিন্ন রণাঙ্গনের সৈনিক। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতার শরিকও ছিল। তবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ফাঁসি ও বিএনপির আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির প্রতি মনোযোগ—এই দুইয়ের সংমিশ্রণে সেই সম্পর্ক পেয়েছে এক পরিমিত দূরত্ব। তবু শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অন্তরালে দুই দলই এগোচ্ছিল এক অব্যক্ত বোঝাপড়ায়।

আজকের বাস্তবতায়, যখন শাসকের গদি ফাঁকা, রাজনীতির মঞ্চে নতুন মুখের অপেক্ষা, তখন আবারও কাছাকাছি আসতে চাইছে বিএনপি ও জামায়াত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুতির এ এক নিরব ঘোষণা। যদিও এখনো জামায়াতের নিবন্ধন ফেরেনি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাও বহাল—তবু নির্বাচনের অনিশ্চয়তা ও রাস্তায় ফের নেমে পড়ার সম্ভাবনা একে নতুন দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তারেক রহমানের এই বৈঠকে উপস্থিতি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এক সময় জামায়াতের বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত এই নেতা বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের উপায় হিসেবে হয়তো জামায়াতের ঘরোয়া সংগঠনী শক্তি ও প্রবাসভিত্তিক প্রভাবকে কাজে লাগাতে চাইছেন।

অন্যদিকে, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা দেশে ফেরার কূটনৈতিক পথ খুঁজছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছে। আর ভারত সরকার চায় সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখতে। এমন প্রেক্ষাপটে বিএনপি-জামায়াতের ফের কাছাকাছি আসা পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নানা ধরনের বার্তা দিতে পারে —মিলতে পারে একটি সম্ভাব্য নতুন ক্ষমতাকাঠামোর আভাস।

তবে নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। জামায়াতের রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরার আইনি পথ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে আন্দোলনের মাঠে আবারও উত্তাপ বাড়বে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।

আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি সম্ভবত খেলতে চাইছে ‘সুযোগের রাজনীতি’, আর জামায়াত চাইছে নিজ অস্তিত্বের স্বীকৃতি। দুই পক্ষই একে অপরকে প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে দেখছে। কিন্তু যদি এই জোট সত্যিকার নেতৃত্ব, নীতির স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকে গড়ে ওঠে—তবে তারা হয়ে উঠতে পারে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও তাদের সম্ভাব্য জোটসঙ্গীদের বাইরে দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক বিকল্প।

লন্ডনের ওই আলোচিত সাক্ষাৎ নিছক সৌজন্যের আবরণে ঢাকা থাকলেও, এর অন্তরালের সুর হলো পুনর্গঠনের আভাস। শেখ হাসিনাহীন রাজনৈতিক প্রান্তরে যারা সামনে আসতে চায়, তাদের কৌশলের বীজ এখনই বপন হচ্ছে। কিন্তু এই জোট সত্যিই কি নবতর গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নামবে, নাকি অতীতের ছায়া টেনেই গড়ে তুলবে রাজনৈতিক সুবিধাবাদের আরেক খণ্ডচিত্র? সে প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে। বিএনপি-জামায়াতের স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সন্ধির প্রতীক্ষার উপক্রমণিকা বুঝতে হলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আরো খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক
১৬ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login