Posts

চিন্তা

শিল্পীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা সরকারের ব্যর্থতা

April 16, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

99
View

Effigy—শব্দটির অর্থ হচ্ছে কোনো ব্যক্তির প্রতীকী অবয়ব বা কল্পিত প্রতিকৃতি, যা সাধারণত প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধ্বংস করা হয়। বিশ্বজুড়ে এ ধরনের প্রতীক নির্মাণ করে মূলত সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নিজেদের রাগ-বিরাগ, ক্ষোভ কিংবা অভিমান জানাতে।

কিন্তু বাংলাদেশে সবকিছুই যেন উল্টো ধারায় চলে। এখানে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের আক্রোশ চরিতার্থ করতে পরাজিতদের বিরুদ্ধে ঘৃণার আগুন জ্বালাতে কুশপুতুল বানায়, যার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে একজন শিল্পী কিংবা নিরীহ নাগরিকের ওপরে।

এবারের পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি' শীর্ষক এফিজি নির্মাণ করায় মানিকগঞ্জের শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পরিবারের দাবি অনুযায়ী, ১৫ এপ্রিল দিবাগত রাতে এই ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। মানবেন্দ্র ঘোষ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন—তিনি এবং তাঁর পরিবার বর্তমানে জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং সরকারের কার্যকর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন।

ঘটনার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। অথচ এর আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা এ ঘটনায় কারা জড়িত, সে বিষয়ে স্পষ্ট ভাষায় মত দিয়ে ফেলেছেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন—“শিল্পী মানবেন্দ্র ঘোষের বাড়িতে যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে ধরতে পুলিশ কাজ শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর ভাই আইজিপিকে পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছেন। গত কয়েকদিন যাবত অনলাইনে বিতাড়িত আওয়ামী লীগের কর্মীরা মানবেন্দ্র ঘোষকে আক্রমণের উসকানি দিচ্ছিল। তাদের ভাষ্যে, ‘হাসিনার এফিজি বানানোর অপরাধে’। এদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।”

আমরা নির্দ্বিধায় বলি—রাজনৈতিকভাবে অসহিষ্ণু একটি দেশে নির্দিষ্ট কোনো শিল্পীকে দিয়ে পলিটিক্যাল এফিজি বানানো ঔচিত্যের কাজ ছিল না। যদি আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদী প্রতিকৃতি নির্মাণ করতো, তবে হয়তো এমন ভয়াবহ প্রতিশোধের দৃশ্য দেখতে হতো না।

তবে, শিল্পীর সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারা—এটা নিঃসন্দেহে সরকারের দায়িত্বে গাফিলতি এবং চরম ব্যর্থতা। আপনারা হয়তো ভবিষ্যতে সেই মানুষটির মাথার ওপর একটা নতুন ছাদ তুলে দিতে পারবেন। কিন্তু যে ঘরটি ছিল তার শিল্পচর্চার পবিত্র পরিসর, পূর্বপুরুষের স্মৃতিবহ আশ্রয়, হৃদয়ের গড়া নিটোল নিঃসঙ্গতা—তার ঐতিহ্য আর ফেরানো যাবে না।

আপনারা হাজারটা দোষী ধরতে পারেন, শাস্তিও দিতে পারেন, কিন্তু মানবেন্দ্র ঘোষ যা হারিয়েছেন, তা আর ফিরে পাবেন না। প্রশ্ন উঠে—একজন নিরব, নির্বিরোধ শিল্পীকে এমন এক অগ্নিপরীক্ষায় কেন ফেলবেন যেখানে তিনি সর্বস্ব হারাবেন? এই আগুনে যদি তার প্রাণটাই ঝরে যেত, তবে তার জবাব কে দিত?

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক একটি ঘটনা স্মরণযোগ্য। গত ৫ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। ট্রাম্পের নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভে অংশ নেয় প্রায় দেড়শ গোষ্ঠী। ৫০টি অঙ্গরাজ্যে একযোগে আয়োজিত হয় প্রায় ১২০০টি সমাবেশ।

লস অ্যাঞ্জেলেসে বিক্ষোভকারীরা ট্রাম্পের বিশালাকার 'Float’ বহন করে, যা ছিল তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদের প্রতীক। এর আগেও আমরা ইউরোপ-আমেরিকায় Giant ‘Trump Baby' Blimp-এর মতো প্রতিবাদী প্রতীক দেখেছি।

কিন্তু কখনোই এসবের নির্মাতা কিংবা প্রদর্শনকারীদের ওপর হামলা হয়নি। কারণ, সেই দেশগুলোতে ‘জনতার প্রতিবাদ’কে সমীহ করা হয়, মর্যাদা দেওয়া হয়। সেখানে শিল্পীর কাজকে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়, বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে নয়।

অথচ আমাদের দেশে সরকার ক্ষমতায় থাকলে তারা নিজেরাই রা'জাকারের এফিজি বানায়; আর ক্ষমতা হারালে নিজেরাই পরিণত হয় কুৎসিত effigy, float কিংবা blimp-এ। এতে ধ্বংস হয় না কোনো ক্ষমতাধরের ঘর বা উপদেষ্টার উঠোন; পোড়ে শুধু শিল্পীর বসতবাড়ি।

আমরা এমন ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির বদল চাই। শিল্পীর ঘর পোড়ানোয় রাষ্ট্রকে বিব্রত হতে হবে, হতে হবে লজ্জিতও।

রাষ্ট্রের কাছে আমাদের আহ্বান—
অনুগ্রহ করে অতীত ভুলের দাসত্বে বন্দি হয়ে থাকবেন না। স্বাধীন মত প্রকাশ ও শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। কারণ, একমাত্র শিল্পই পারে সমাজকে আয়নার মতো দেখাতে। আর আয়না ভাঙলে প্রতিবিম্বের মুখই অদৃশ্য হয়ে যায়।

লেখক: সাংবাদিক
১৬ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login