দ্বিতীয় দরজাটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে—আলিফের দিকে যেন তাকিয়ে আছে সেটা। রক্তে লেখা সেই লাইন বারবার চোখে ভাসছে:
"প্রত্যেক গল্পের এক খরচা আছে। তুই কতটা দিতে পারবি?"
দরজার হাতল স্পর্শ করতেই হিমেল একটা শীতকণিকা আঙুল বেয়ে ঢুকে পড়ল আলিফের শরীরে। সে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। দরজার ওপারে ঢুকতেই চারদিক বদলে গেল।
এবার সে এক পাথুরে করিডরে এসেছে। দেওয়ালে ছায়ার মতো ছাপ—কিন্তু যেন মানুষ নয়, প্রাণী নয়, কিছু অব্যাখ্যেয়। মাথায় শিং, হাতে কলম, চোখগুলো ফাঁপা, অথচ যেন তাকিয়ে আছে…
হঠাৎ করেই করিডরের এক কোণ থেকে একটা বিকৃত শব্দ ভেসে এল—"আলিফ…"
আলিফ চমকে পিছন ফিরে দেখে—একটা ছায়া এসে দাঁড়িয়ে আছে। সে দাদুর কণ্ঠ চিনতে পারে। কিন্তু ছায়াটা দাদুর মতো নয়—চোখে গর্ত, মুখটা কালি, আর হাতের আঙুলে রক্ত লেগে আছে।
"তুই দেরি করেছিস… গল্পটা ওরা শুরু করে ফেলেছে…"
আলিফ বলল, "আমি তোমাকে ফেরাতে এসেছি!"
ছায়া-কণ্ঠ হেসে ওঠে, ভীষণ হিংস্রভাবে—"তুই তোর ছায়া হারিয়ে ফেলেছিস, আলিফ। এখন তোর শরীর চাই ওদের।"
এই মুহূর্তে করিডরের চারপাশ থেকে ছায়ারা এগিয়ে আসে—তাদের পায়ে শব্দ নেই, চোখ নেই, কিন্তু কণ্ঠে ফিসফিসানি:
"তুই একজন গল্পকার, তোর গল্প আমাদের চাই… তোর স্মৃতি, তোর ভয়, তোর প্রেম, সব…"
আলিফ পেছন দিকে হেঁটে যায়, তখন হঠাৎ তার পায়ে ঠেকে একটা পুরনো ঘড়ি—দাদুর সেই লেখার ঘড়ি। সে ঘড়িটা তুলে নিয়ে দেখল, ঘড়ির কাঁটা উলটোদিকে ঘুরছে।
সে বুঝতে পারে—এটা একটা পথ। নিজের স্মৃতিতে ফিরতে হবে। একেকটা স্মৃতি একেকটা দরজা। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে, ভাবে সেই রাতটার কথা—যেদিন সে প্রথম ছায়ার মানুষ দেখেছিল, সেই শহরে, ছোটবেলায়। চোখ খুলতেই সে পৌঁছে যায় একটা ঘরে—আয়নায় মোড়া, আর তার সামনে ছোট এক ছেলেটা দাঁড়িয়ে, যেন তার শৈশবকাল।
ছেলেটা বলে,
"তুই নিজেকে ভুলে গেছিস। গল্পের শক্তি তুই। তুই যদি মনে রাখিস কে ছিলি, তুই ওদের হারাতে পারবি।"
পেছন থেকে ছায়ারা চিৎকার করে উঠল—"না!!! আমাদের নাম কেউ উচ্চারণ করতে পারে না!"
আলিফ তখন স্পষ্ট উচ্চারণ করে দাদুর শেষ লেখার লাইন:
"ছায়া শুধু তখনই শক্তিশালী, যখন আলো ভয় পায়।"
এক ঝলক আলো, ঠিক আয়নার মতো তীব্র—আর ছায়ারা চিৎকার করে মিলিয়ে যেতে লাগল একে একে…
দরজা আবার খুলল। এবার সে পৌঁছায় এক ঘরে, যার মাঝখানে বাঁধা একটা চেয়ার। সেখানে বসে আছেন হাশেম আলী। চোখ বন্ধ, নিঃশ্বাস ধীর…
আলিফ ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে যায়…
চলবে…