Posts

প্রবন্ধ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস(পর্ব-১১)

April 17, 2025

Yousuf Haque Chowdhury

154
View

সংঘর্ষের ইতিহাসঃ

১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লক্ষ ৬০ হাজার। আমরা আগেই জেনেছি বহুকাল ধরেই ফিলিস্তিন ভুমিতে ইহুদী সম্প্রদায়ের মানুষজন বাস করতো। কয়েকটি ইহুদি গোত্রের সীমিত সংখ্যক লোকের বসবাস ছিল। ইহুদীরা ছিল ফিলিস্তিনের পুরো জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। তা সত্ত্বেও সেখানে মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদী সবাই অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছিল।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপ জুড়ে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন ইহুদী নিধন শুরু হয়। সেখান থেকে ইহুদিদের মধ্যে জায়নবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। ইহুদীরা নিজেদেরকে সঙ্গবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং ইউরোপ ত্যাগের পরিকল্পনা শুরু করে। তখন থেকেই মূলত ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার অধ্যায় শুরু হয়।

এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেন দূরদর্শী এক ইহুদী সাংবাদিক, ডঃ থিওডর হার্জেল যিনি ছিলেন জায়োনিজম আন্দোলনের প্রবক্তা।প্যারিসে বসবাস করলেও তিনি ভিয়েনার একটি বিখ্যাত পত্রিকায় কাজ করতেন। ইউরোপে ইহুদিদের নির্দ্বিধায় হত্যা, বিতাড়ন আর তাদের প্রতি নীরব ঘৃণা দেখে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ১৮৯৬ সালে তার লেখা বই The Jewish State- এ তিনি ধর্মকে টেনে আনেন। প্রসঙ্গক্রমে বাইবেল থেকে তিনি খুঁজে আনেন আব্রাহামকে যাকে ইহুদিরা ধর্মীয় পিতা মনে করে।

হার্জেল তার বইতে লেখেন, “আব্রাহামের পুত্রদের ঈশ্বরের দেওয়া ভূমিটা ফিরিয়ে দাও, ঈশ্বর যে পবিত্র ভূমিটা আব্রাহামের পুত্রদের দিয়েছিলেন, সেটা পড়েছে ফিলিস্তিনে, আর এর প্রকৃত মালিক কেবল ইহুদিরা”! তিনি দুর্দশাগ্রস্ত বিক্ষিপ্ত ইহুদীদের একত্রিত করে একটি স্বতন্ত্র ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারনা প্রণয়ন করলে তারপর থেকে চলে ইহুদিদের ভূমি ফিরে পাওয়ার জোর তৎপরতা। 

এরপর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইহুদীরা বেশ কিছু সম্মেলনের আয়োজন করে। স্বতন্ত্র ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনের বিকল্প হিসেবে আর্জেন্টিনা এবং আফ্রিকার মোজাম্বিক ও উগান্ডার নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ফিলিস্তিন ভূমিকেই ইহুদিরা মনেপ্রাণে নিজেদের ভূমি মনে করত। কারণ তারা জানতো তাদের পূর্ব পুরুষ একসময় রোমানদের দ্বারা ফিলিস্তিননেরর এই পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো, বিশেষত ইউরোপে। তাই ধর্মীয় ভাবধারায় তারা ফিলিস্তিনকেই তাদের কল্পিত রাষ্ট্র হিসেবে নির্বাচন করে।

থিওডর হার্জেলের উদ্যোগে ১৮৯৭ সালে ইহুদিদের জন্য “World Zionist Organization” গঠন করার মাধ্যমে জায়নবাদী/ জায়োনিস্ট (Zionist) আন্দোলন শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রভাবশালী ইহুদীরা এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহযোগিতা করতে তাদের দেশের সরকারকে চাপ দিতে থাকে। একই সাথে শুরু হয় ফিলিস্তিন অভিমুখে ইহুদী শরণার্থীদের যাত্রা। 

প্রথম দফায় পূর্ব ইউরোপ (রুমানিয়া,পোল্যান্ড) ও রাশিয়া থেকে ২৫০০০ ইহুদী শরণার্থীদের আগমন ঘটে ফিলিস্তিনে। ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদী জনসংখ্যা ৫ শতাংশে উন্নিত হয়। এভাবে একেরপর এক ইহুদী কাফেলা ফিলিস্তিনে আসতে থাকলে তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের তীব্র সংকট দেখা দেয়। এমতাবস্থায় জেরুজালেমের গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ অটোমান শাসকদের কাছে অনুরোধ জানায় যেন তারা ইহুদী শরণার্থীদের আগমন ও তাদের ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু অটোমান সম্রাজ্য তখন ক্ষয়িষ্ণু শক্তি। এই সুযোগে ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে আরো ৪০,০০০ ইহুদী ফিলিস্তিনে এসে একত্র হয়। ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদী জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৮ শতাংশে। উল্লেখ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে গেলে ফিলিস্তিনের ক্ষমতা পায় ব্রিটিশরা। ব্রিটিশরা তখন থেকেই সেখানে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জোর তৎপরতা চালাতে থাকে।

সাইকস-পিকট চুক্তি

১৯১৫ সালের নভেম্বর মাসে বৃটেন আর ফ্রান্সের মধ্যে  আলোচনা শুরু হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালিন ১৯১৬ সালের ১৬ মে ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স লন্ডনে একটা গোপন চুক্তি করে। এখানে ফ্রান্সের পক্ষে কূটনীতিক ফ্রাঙ্কোস জর্জ পিকট এবং ব্রিটিশ পক্ষে কূটনীতিক স্যার মার্ক সাইকস এতে স্বাক্ষর করেন। তৃতীয় সদস্য রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সের্গেই দিমিত্রিয়েভিচ সাজোনভও উপস্থিত ছিলেন। এটি সরকারিভাব এশিয়া মাইনর চুক্তি হিসেবে পরিচিত। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরষ্ক পরাজিত হলে অটোমান সম্রাজ্যের কার্যত পতন ঘটে। তখন এই চুক্তির আওতায় মিত্রশক্তি ফ্রান্স ও ব্রিটেন নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ পরবর্তী অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানোর চেষ্টা শুরু করে। ঐক্যমতের ভিত্তিতে আরব উপদ্বীপের বাইরে অটোমান সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চলগুলো ব্রিটিশ ও ফরাসি নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবাধীন এলাকায় বিভক্ত হয়। লেখক জেমস বার এভাবে বলেন- “ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাব্য বিজয়ী শক্তি পরাজিত অটোমান সাম্রাজ্যের এই অঞ্চলকে ভাগাভাগি করতে গিয়ে ‘মরুভূমির বালিতে একটি রেখা’ আঁকে”। 

এই রেখার উত্তরের অংশের ব্যাপ্তি ছিল ভূমধ্যসাগরে উত্তর ফিলিস্তিনের বন্দর আক্কা থেকে শুরু করে ইরান সীমান্তে উত্তর ইরাকের কিরকুক পর্যন্ত। ফলে বর্তমান লেবানন ও সিরিয়া যায় ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রনে। আর তার দক্ষিণের ফিলিস্তিন, জর্দান ও ইরাক যায় গ্রেট ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রনে। এই ভাগাভাগিতে সোভিয়েত রাশিয়ার সম্মতি ছিল। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ত্রিপক্ষীয় মধ্যস্ততার উদ্দেশ্য এই চুক্তিতে বিবৃত হয়। মূলত সুয়েজ খালের আশপাশের অঞ্চলে ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই বন্দোবস্ত করা হয়, যেটা ছিল ব্রিটিশ ভারতে যাওয়ার প্রধান নৌপথ। 

Comments

    Please login to post comment. Login