Posts

সমালোচনা

বৃষ্টির দিন ভাড়া বেশি কেন??? (পাঠ পর্যালোচনা ০২)

April 17, 2025

দীপক কর্মকার

136
View

পড়লাম তানজীম রহমানের লেখা 'বৃষ্টির দিন ভাড়া বেশি'। ব্যতিক্রমী নাম ও প্রচ্ছদ এবং বইপাড়ায় উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনা দেখেই বইটি পড়ার ইচ্ছা জাগে। 


লেখক তানজীম রহমান কিংবা তাঁর লেখার সাথে আমার কোন পরিচয় ছিল না। সমকালীন লেখকের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই এমন হয় যে, যতটা নামডাক শোনা যায়, বই পড়তে গেলে সেই নামডাকের পরিচয় পাওয়া যায় না। এইক্ষেত্রে তানজীম রহমান আমাকে হতাশ করেননি।

যেকোনো গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রে, গল্পটি কেমন সেটি আমার কাছে প্রাধান্য পায় না, গল্পটা কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটাই আমার কাছে প্রাধান্য পায়। আবার, পুরো একটা গল্প না পড়ে গল্পটা কেমন সেটা যেমন জানা বা বোঝা যায় না, তেমনি গল্পটি সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তও নেওয়া যায় না। কিন্তু, কোন বইয়ের অন্তত একটি পাতা পড়েই বোঝা যায় লেখকের লেখা কেমন। তাই গল্প পরের বিষয়, লেখার ধরণটাই আমার কাছে মূখ্য। 'বৃষ্টির দিন ভাড়া বেশি' পড়ার পরে মনে হলো গল্পটিও যেমন সুন্দর, লেখকের লেখাও বেশ।

গল্পটি লেখক খুব সাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন, একদম নাটকীয়তা ছাড়া। এমনকি গল্পটি শেষ করে মনে হবে শেষে একটু টুইস্ট বা একটু টানটান উত্তেজনা থাকলে মন্দ হতো না। কিন্তু আগেই বলেছি, লেখক কোনরকম নাটকীয়তাকে প্রশ্রয় দেননি, বরং—গল্পটি যেমন হতে পারত—তেমন করে লিখেছেন। ফলে, হরু নামক কল্পনাপ্রবণ একজন রিকশালচালক, যার রিকশায় চড়ে মৃত আত্মারা বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করে এবং সেই মৃত আত্মা তাকে নানান ঘটনার মারপ্যাচে ফেলে দেয়— এসব পড়েও মনে হবে যেন এটা খুবি সাধারণ একটি বিষয়। আবার এই আত্মারা ভূত হলেও, গল্পটাকে ভূতের গল্প যেমন বলা চলে না, একইভাবে লেখাটিকে জাদুবাস্তবতাও বলা যায় না।

গল্পে রিকশাচালকের সাথে আছেন একজন দর্শনের অধ্যাপক, যিনি সোজা কথায় নাস্তিক এবং জীবনের উদ্দেশ্য তিনি জানেন। একইসাথে মরণের পরের দুনিয়া নিয়েও তাঁর আগ্রহ আছে। হরুর রিকশায় চড়ে তিনি সেই অজানাকে জানার একটি সুযোগ পান। আর একজন ব্যবসায়ী আছেন, যিনি ধার্মিক এবং মৃতদের আত্মা নিয়ে তাঁর একটি বিশেষ পরিকল্পনা আছে। আর এক অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার যিনি মৃত আত্মাকে জীবিত করার কৌশল জানেন। এর বাইরে কিছু মানব চরিত্রের সাথে কিছু মৃত আত্মার কথাও আমরা জানবো, সেই মৃত আত্মার মধ্যে জ্যোতি নামের অভিমানী মেয়েটি অন্যতম। অল্প-স্বল্প করে আমরা মোটামুটি সবার গল্পই শুনতে পাই এবং কিঞ্চিত বিশৃঙ্খল ঘটনার পরে একটি সহজ পরিণতির মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়ে যায়।

লেখকের বর্ণনায় কিঞ্চিত শহীদুল জহিরের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আর কিছু ক্ষেত্রে বর্ণনা কিছুটা ঝাপসা থেকে যায়, ফলে বুঝতে মাঝে-মাঝে সমস্যা হয়। আর যতি চিহ্নের ব্যবহার (বিশেষত কমার ব্যবহার) হয়তো লেখকের ইচ্ছাতেই হ্রাস করা হয়েছে। কমার ব্যবহার না থাকলেও অনেক জায়গায় কোলনের ব্যবহার দেখা যায়। সংলাপের ক্ষেত্রে যেকোনো এক নিয়ম ব্যবহার করলে বিষয়টা ভালো হতো বলেই মনে করি। 
লেখক ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের যে বর্ণনা দিয়েছেন, ঢাকা শহরে তাঁর চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্য ও নিয়মমাফিক বিচরণ একটি অলৌকিক গল্পকে বাস্তবভাবে উপস্থাপনে সহায়তা করেছে। এমনকি কড়াইল বস্তির এক অংশে যে মূল রাস্তা থেকে বস্তিতে যাওয়ার জন্য নৌকা ব্যবহার করতে হয় সে অংশটুকুও লেখক বাদ দেননি।
গল্পটিতে একজন দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক আছেন বলেই নয়, দর্শনশাস্ত্রের বিষয়ে লেখকের জানাশোনা ও আগ্রহের বিষয়টি এবং নিজস্ব দর্শনের পরিমিতি ব্যবহার গল্পটিতে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

আফসার ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ ভালো লেগেছে। রিকশা পেইন্টিং-এর ধাঁচে প্রচ্ছদটি এঁকেছেন শ্রাবণ। ৬ ফর্মার ২৫০ টাকা মলাটমূল্যের বইটির প্রোডাকশন বেশ ভালো, তবে কিছু প্রিন্টিং মিসটেক আছে।

সবশেষে বৃষ্টির দিন ভাড়া বেশি কেন তার উত্তরটা দেওয়া যেতে পারে। হরু যেহেতু জানে তার রিকশায় বৃষ্টির দিন মৃত আত্মারা যাতায়াত করে, তাই বৃষ্টি দেখলে সে মানুষের কাছে বেশি ভাড়া দাবি করে, যেন কোন জীবিত ব্যক্তি তার রিকশায় না চড়ে৷ এজন্যই বৃষ্টির দিন ভাড়া বেশি।

সবমিলিলিয়ে ফ্যান্টাসি ঘরানার বইটি ফিকশন প্রেমীরা চাইলে পড়তে পারেন। ধন্যবাদ।

দীপক কর্মকার
১২ এপ্রিল'২৫

Comments

    Please login to post comment. Login