আমার অর্থবিত্ত থাকা সত্ত্বেও আমি আমার একমাত্র ছেলেকে কখনও দিনে দশ টাকার বেশি টিফিন খরচ দেইনি।
সে বরাবরই তাঁর বিভিন্ন বন্ধুদের দেখিয়ে বলে- বাবা দেখো, আজ সে ওই ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরে এসেছে।
বাবা দেখো, তার স্কুল ব্যাগটা ইম্পোরটেট, দেখতে অনেক সুন্দর তাই না বাবা?
আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাই।
আমার ছেলের কোনো দিনও এই সাহস কিন্তু হয়নি যে কখনও আমার কাছে সেই জিনিসটা চাওয়ার।
একদিন সে তাঁর পায়ে সামান্য ব্যাথা পেলো।
স্কুলে যাওয়ার সময় বললো, বাবা আমাকে তোমার সাথে অফিসের গাড়িতে করে নিয়ে স্কুলে নামিয়ে দেবে?
আমি তার সমস্যার কথা বিবেচনা করে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে চলো।
এরপর প্রায় এক সপ্তাহ সে আমার সাথে গেলো।
আমি চুপচাপ তাঁকে নামিয়ে দিতাম।
আমার ছেলের এখন দেখছি হেঁটে যেতে আর ইচ্ছে করছে না।
পরের দিন সকালে আমার সাথে যাবে এ কথা বলার আগে আমি বলে দিলাম অফিসিয়াল জিনিস ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য নিষিদ্ধ।
বাড়ি থেকে স্কুল দশ মিনিটের পথ নির্দিষ্ট সময়ের আরও কিছুক্ষণ আগে বের হবে তাহলেই তুমি সময় মতো হেঁটে যেতে পারবে।
এই কথাতে ছেলে আমার প্রচন্ড মন খারাপ করে বসে রইলো।
এদিকে এই কারণে আমার সাথে স্ত্রী মন খারাপ করেছে।
কেন করি এমন?
এর প্রকৃত উত্তর আমার হয়তো জানা নেই।
আজ সন্ধ্যায় ছেলে আমার বাড়িতে এসে বলেছে- জানো বাবা আমার এক বন্ধু শহরের সবচেয়ে সেরা স্কুলে ভর্তি হয়েছে।
আমি ও কি সেখানে…
এ কথা বলার আগেই আমি তাকে থামিয়ে জানতে চাইলাম- বাবা প্রতিষ্ঠান সেরা হয়, নাকি ছাত্র সেরা?
ধরো, আমি তোমাকে সেই স্কুলে ভর্তি করে দিলাম কিন্তু তুমি ফেল করলে কোনো সাবজেক্ট
তাহলে আমি কী বলবো তুমি ফেল, নাকি স্কুল ফেল?
ছেলে আমাকে বললো- আমি বুঝেছি বাবা।
আমি তাঁর মাথায় হাত দিয়ে বললাম- এই পর্যন্ত তোমার ক্লাসের কোনো ছেলে তোমাকে টপকে যেতে পারেনি, তুমি তো ফার্স্ট বয় সুতরাং তুমি যেখানে তোমার সেরাটা দেবে সেই স্থানই তোমার মতো সেরা।
এরপর সে আর এরকম কোনো কথা আর কোনো দিন বলেনি৷
আজ বিকেলে ছেলে বলেছে- বাবা, একজন এক্সট্রা টিউটর দরকার।
আমার ম্যাথ ওইংলিশ পড়তে একটু সমস্যা হচ্ছে।
আমি ছেলেকে বললাম- বাবা, একটু কষ্ট করতে হবে যে
আমি যখন রাত করে বাড়ি ফিরবো নয়টা কিংবা দশটায়
তখন আমার কাছে তোমাকে ম্যাথ ও ইংলিশ করতে হবে।
বাবা, তুমি তো অনেক পরিশ্রম করে রাতে বাড়ি আসো, তাই না?
আমি হেসে বললাম-
না, বাবা আমার কাছে এত সামর্থ্য নেই যে, তোমাকে এক্সট্রা একটা টিউটর দেওয়ার। তার চেয়ে আমি না হয় বরং একটু কষ্ট করি
তুমি কি বলো?
ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো- ঠিক আছে বাবা।
স্ত্রী রাতের বেলা একটু রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো এ রকম দশটা টিউটর রাখতে পারো কিন্তু তাহলে এমন করে বললে কেন?
আমি আমার স্ত্রী কে বললাম- আমি চাই আমার সন্তান বুঝুক যে আরাম করে খুব সহজে সবকিছু পাওয়া যায় না। মানুষের জীবনে অভাব আসলে তা কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়?
সে বুঝুক ও শিখুক কোন জিনিসটা ভালো বা মন্দ। সেটা সে সত্যিকার অর্থে বুঝুক।
আমার কথা শুনে আমার স্ত্রী একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।
মাঝে, মাঝে আমার ছেলেকে নিয়ে আমি ইচ্ছে করেই ফুটপাতে হাঁটি। পথশিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানুষের সম্পর্কে তাকে জানাই। সে জানে পৃথিবী শুধু চিন্তাই সুন্দর, বাস্তবে খুবই কঠিন।
আমি চাওয়া মাত্রই তাঁকে কোনো দিনও কোনো কিছুই দেইনি।
একদিন সে আমাকে বলেছিল বাবা তুমি এরকম কেন?
তাঁকে শুধু বলেছিলাম- বাবা, সময় হলে তুমিও বুঝবে।
কয়েকদিন আগে সে বায়না ধরলো ইলিশ ও মাংস পোলাও খাবে।
আমি তাকে বললাম, আমার কাছে তো ইলিশ মাছ কেনার মতো এতো টাকা নেই
তোমার কাছে কিছু টাকা আছে কি?
তোমার কাছে কিছু থাকলে হয়তো ইলিশ মাছ আনা যাবে।
ছেলে আমাকে পঞ্চাশটি দশ টাকার নোট বের করে দিলো।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি খরচ করোনি?
সে মুচকি হাসি দিয়ে বললো- না, বাবা জমিয়েছি।
আমার পরিচিত এক বন্ধু স্কুলে না খেয়ে প্রায়ই আসে, ওর তেমন কোনো টাকা নেই৷
আসলে সে খুব অসহায়, বাবা!
আমি মাঝে মধ্যে তাঁকে ক্ষুধার্ত থাকতে দেখি, আমি ওকে দেখেই বুঝতে পারি।
সেদিনই তার সাথে মিলে খাই, অন্য দিনগুলোতে টাকা খরচ না করে আমি টাকা জমিয়ে রাখি।
কারণ বাড়ি থেকে মা যা দেয় তাতেই যথেষ্ট। তাছাড়া কিছু মানুষ তো এই সামান্যটুকুও পায় না।
আমি ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।
সে তাঁর গোছানো টাকা নিয়ে আসে আরও কিছু টাকা মিলিয়ে ইলিশ কিনে ছেলেকে ইলিশ ও মাংস পোলাও খাওয়ালাম।
আমি ইচ্ছে করেই অভাব অনুভব করাই যাতে সে বুঝুতে পারে জীবনটা কঠিন অনেক কঠিন।
পুজোর বাজারে গিয়ে তাঁকে বলেছি, সাধ্যের মধ্যে কিছু কিনে নিতে।
সে শুধু একটা প্যান্ট নিয়েছে।
জানতে চাইলে বললো- আমার জন্য নাকি পাঞ্জাবি আর ওর মায়ের জন্য শাড়ি নিয়েছে।
শুনে আমি খানিকটা মুচকি হাসলাম।
এ হাসি সুখের হাসি, এ হাসি বিজয়ের হাসি।
কারন আমি তাঁকে যা বুঝাতে বা শিখাতে চেয়েছিলাম তা আমি তাঁকে শেখাতে বা বুঝাতে পেরেছি।
সে বুঝতে শিখেছে যে, টাকা কীভাবে খরচ করতে হয়?
একদিন সে আমার কাছে এসে আমার পাশে বসে বলছে, বাবা আমার বন্ধু সায়নটা আর মানুষ হল না।
অথচ আঙ্কেল তার জন্য নিজেকে সব উজাড় করে দিয়েছেন যাচ্ছে। সে তার সবটাই তাঁকে দিয়েছেন।
আমি ছেলেকে বললাম, আমি কি তোমাকে কিছু দিতে পারিনি?
ছেলে আমার কোলে মাথা রেখে বললো, প্রতিটা চাহিদা কিভাবে পূরণ করে নিতে হয় সেটা শিখিয়েছো।
অভাবে যেনো স্বভাব নষ্ট না হয় সেটা শিখিয়েছ।
তুমি আমাকে জীবনের যে শিক্ষা দিয়েছে বাবা তা তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে।
তুমি আমাকে শিখিয়েছ অভাবকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়, আমি এখন জানি আমার বাবার আমি ছাড়া আর কিছুই নেই৷
বাকিটা আমাকে করে নিতে হবে, সব কিছু সঠিক ভাবে ইউটিলাইজ করতে হবে।
আমি এখন সাধারণ জামা কাপড়েও কোন হীনমন্যতায় ভুগি না বাবা৷
কারণ আমি জানি যে আমি কে?
তোমার দেয়া এই শিক্ষা আমি সারা জীবন ধরে রাখবো।
বাবা আমার চাহিদা মোতাবেক সব পেয়ে গেলে আমি কখনও জানতামই না যে, পঞ্চাশ দিন টিফিন না খেয়ে টিফিনের টাকা জমালে পাঁচশ টাকা জমা হয়।
তুমি আছো বলেই তো এটা বোঝা সম্ভব হয়েছে।
আমি মানুষকে মানুষের চোখে দেখি, আমি বুঝি যে জীবন কতোটা কঠিন।
আমার স্ত্রী নিজ থেকেই আজ খুব খুশি কারন উনি আজ বুঝতে পেরেছেন আমার প্রকৃত উদ্দেশ্যটা।
প্রায় দশ বছর পর ছেলে একটা প্রাইভেটকার কিনেছে নিজের রোজগারে। সে হাসতে হাসতে বলে বিগত আট বছরে টিফিনের টাকা আর বোনাসের টাকা জমিয়ে এটা কিনেছি।
বুঝতে পেরেছিলাম, ছেলে আমার সঞ্চয়ী হয়েছে সাথে হয়েছে প্রকৃত মানুষ।
সপ্তাহ খানেক পর যাবতীয় সম্পত্তি তার নামে লিখে দিয়ে বললাম- সবকিছু সামলে রেখো।
ছেলে দলিলগুলো আমার হাতে দিয়ে বললো- তোমরা শুধু আমার সাথে থেকো আর কিছু লাগবে না।
আজ তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার স্ত্রী নীলিমাকে বললাম, দেখেছো আমি ভুল করিনি।
আমি আমার সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটা দিয়েছি, যেমন করে আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন।
আমি আমার সন্তানকে সুস্থ ভাবে লজ্জিত হওয়া নয়, বরং দৃঢ় থাকতে শিখেছি।