যেসব লোক মারা যাবেন তারা জল দেখছিলেন। তখন বিকাল। রাস্তায় সোনালী সোনালী রোদ। মারা যাবেন এমন লোকেরা সংখ্যায় তিনজন। লেকের পারে পাথরের গোল টেবিল। ঠান্ডা পাথরের চেয়ার। তিনটি চেয়ারে বসে তিনজন লেকের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। লেকটির জল সবুজ এবং শ্যাওলাসংকুল। বিকেলের রোদ জল থেকে ফেরত এসে তাদের মুখে পড়ছিল। যদিও তারা জানতেন না সেটা। তারা ভাবছিলেন যে রোদ জলে ভিজে, সেই রোদ জলেই থেকে যায়। থেকে থেকে এককালে মরে যায়। আর রাস্তায়, গাছের পাতায়, মানুষের চেহারায় পড়ে থাকা রোদেরা ভিন্ন। রোদ বা সেই অর্থে জাগতিক সকল বিষয়ের চলাফেরা সমন্ধে তাদের এজাতীয় ভ্রান্তি ছিল। এবং মৃত্যুর সন্নিকটে এসেও সেই ভ্রান্তি দূর হয় না। তখন একজন বললেন যে,
- আমার একটা ইচ্ছা ছিল বুঝলেন, মানে মনে হইত আরকী যে এই লেকের পানিতে একটা ডুব দিয়ে একদম নীচে চলে যাই। অনেক দিন বিরিজের উপ্রে দাড়ায়ে দাড়ায়ে ভাবসি সেই কথা। কিন্তু করা হল না।
চুল রুপালী হয়ে গেছে একজনের এদের মধ্যে, তিনি বললেন,
- আপনার ইচ্ছাটা অনেকটা বিনয়বাবুর মত।
- কে?
- কবি বিনয় মজুমদার। আপনার তো কবিতায় আগ্রহ ছিল না একারণে জানেন না। উনি বলেছিলেন " সাধ জাগে বড় সাধ জাগে, ডুব দিয়ে দেখে আসি নধর জলের নীচে আকাশের অভিমুখী কোন উন্মুখ কুড়ি আছে কি না।
অবশিষ্ট যিনি চশমা পড়েন তিনি বললেন,
- লেকের জলটা ইজন্ট নধর। ময়লা। পোলাপান পস্রাব করে করে ভরায় ফেলসে। এটাতে ডুব দেয়ার রুচি হয় কী করে কারও আমি ত বুঝি না।
প্রথমজন বেশ বিরক্ত হলেন। চোখ কুচকে চশমাওয়ালাকে বললেন,
- আপ্নে তো বাল হয় বেশী বোঝেন নাইলে বোঝেনি না। এই ত করলেন সারাজীবন।
- আরে রাগ করেন কেন বাই। উই আর ডাইং মেন। রাগ আমাদের জন্যে অর্থহীন।
নিকটবর্তী মৃত্যুর স্মরণে আবারো তাদের মন খারাপ হয়। তারা নীরবে জল দেখতে লাগলেন। তারপর বিকাল শেষ হতে না হতেই সন্ধ্যাও শেষ হয়ে যায়। তারপর রাত। খুব জ্যোৎস্না হল চারপাশে। আকাশের নিখুঁত গোল একটা চাঁদ লেকের জলে টলমল টলমল করতে লাগল। এমন জ্যোৎস্নাতেও তারা নির্বিকার থাকেন। তাদের মনে হয় না এই টলমলে জ্যোৎস্না অথবা সকাল সাতটায় লেকের পাশে জগিংরত লোকেরা অথবা সন্ধ্যাকালীন ঝলমলে তরুনীদের মাঝে তেমন কোন ভিন্নতা বিশেষ আছে। মৃত্যুবর্তী লোকেরা এমন হয়ে যায় অথবা তাদের এমন হয়েছিল।
একজন একটা সিগারেট ধরালেন। তিনি বেশ স্বাস্থ্যসচেতন লোক ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে তিনি প্রচুর সিগারেট খান। সেদিন বৃহস্পতিবার রাতে প্রচুর মদও খেয়েছিলেন। পরে রাস্তায় মাতলামি করছিলেন এমন সময় পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। তখন তিনি জানি কাকে ফোন দিলেন আর তাকে ছেড়ে দিল পুলিশরা।
তিনি ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করলেন। দেশী মদের ঝাঁঝাঁল গন্ধে জ্যোৎস্না ভারী হয়ে গেল। আশেপাশে লোকজন ঘুরছে, পুলিশরা হাঁটছে। এই অবস্থায় মদ্যপান কতটা শালীন অথবা নিরাপদ তা নিয়ে বাকি দুজন কিছু বলল না। মৃত্যুবর্তী লোকেরা পুলিশ বা পাব্লিকের বিষয়ে হয়ত অবিচলিত থাকে। তিনি কয়েক চুমুক দিয়ে পাথরের টেবিলে বোতলটি নামিয়ে রাখলে বাকীরাও একটু একটু খেল।
তাদের মধ্যে যার বয়স একটু বেশী তিনি হঠাত খেয়াল করার ভংগিতে বললেন,
- আজকে অনেক জ্যোৎস্না হল, দেখেছেন।
যিনি নতুন সিগারেট মদ খান তার একটু মাথা ঘুরাচ্ছিল, তিনি জড়িত কন্ঠে বললেন
- ফাক জ্যোৎস্না। ফাক ইট অল
বয়স্ক জন বলল,
- আপনার তো ধরে গেল মনে হয়
- অত ধরে নাই। বেশী ধরলে আপনার এই নধর জলের নীচ থেকে একটা ডুব দিয়ে আসব।
অন্য আরেকজন যে ছিলেন, তিনি বললেন,
- এই জ্যোৎস্নাটা কেমন জানি মন-খারাপ মন-খারাপ।
বয়স্ক জন বললেন
- মদ ত খাচ্ছেন, মন ভাল হয়ে যাবে।
- সব মন খারাপ মদে ভাল হয় না।
যিনি নতুন খান তিনি প্রশ্ন করার মত করে বললেন
- এলকোহল হ্যাজ ইটস লিমিটেশন, এইটা বলতে চান তো?
- হুম
- ফাক ইউ ব্রো, ব্লাডি ফাক ইউ
- ভাল
তখন তিনি, যিনি নতুন খান, গান গেতে শুরু করলেন
- " চান্নি রাইতে ফুল বাগানে
ফুল ফুটাইল কে
ও মনয়া ফুল ফুটাইল কে"
বাকী দুজন গানে অংশ নিলেন না। আশপাশ দিয়ে চলমান লোকেরা এই তিন জনকে ঘুরে ঘুরে দেখে। যেন এরকম তিন জন লোক কে আগে কোন দিন দেখা যায় নি। অথচ তারা ছিলেন শুধুই মারা যাবেন এমন তিন জন লোক। এরকম লোকজন সবাই আগেও দেখেছে।
রাত গভীর হতে হতে এক সময় চাঁদ ডুবে যায়। তারা ভাবলেন চাঁদটি হয়তো মরে গেল। চারপাশে গূঢ় অন্ধকার। নীরব। তাদের সামনে টল টলে আঁধারের মত কাল জল।
তিন জন মৃত্যুবর্তী লোক অন্ধকার দেখতে লাগলেন।