আমার দেখা জুলাই অভ্যুত্থান
সুমাইয়া আহমেদ তানহা
সময়টা ২০২৪ সাল।
তখন আমি একাদশ শ্রেণীতে পড়তাম ।
০৭ জানুয়ারি ২০২৪ নির্বাচন ছিল ।
বাবাকে এসে জিজ্ঞাসা করলাম , "বাবা ভোট দিতে যাবে না ?"
বাবা বললেন " না যাবো না "।
আমি বাবাকে উল্টো জিজ্ঞাসা করলাম "কেনো"?।
বাবা বললেন ,"ভোট দিয়ে কি হবে ? দেশতো সেই আগের মতই চলবে । শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ ক্ষমতায় আসবে না" ।
একথা শুনে আমি ভাবলাম , সত্যিই তো !
নির্বাচন দিয়ে কি হবে ? সেই জন্মের পর থেকে আমি শেখ হাসিনাকেই দেখে আসছি , আর ক্ষমতায় তো হাসিনাই থাকবে তাহলে নির্বাচনের কি দরকার ?
কিন্তু বাবা ও মা কেনো ভোট দিতে গেলেন না সেটা আমি বুঝতে পারলাম না।
যাইহোক ,সেটা বোঝার কোনো দরকার আমার নেই।আমি জানি যে শেখ হাসিনা হলেন আমাদের গর্ব ।আর তিনি যোগ্য নেত্রী বলেই দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় আছেন ।তিনি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে আর বঙ্গবন্ধু কত মহান ছিলেন সেটা আমি জানি ।কারণ জন্মের পর থেকে আমি যখনই বই পড়তে শিখলাম তখন থেকেই সব জায়গায় বঙ্গবন্ধুকেই দেখেছি ।অনেক সময় দাদা , আম্মা - আব্বা , কিছু কিছু মানুষের নাম বলতেন । যেমন : শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, ভাসানী ,তাজউদ্দীন আরও অনেকেরই ।আম্মা বলতেন ওনারা নাকি অনেক ভালো ও মহান নেতা ছিলেন।কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নি , কারণ ওনারা যদি সত্যিই এত বড় নেতা হতেন তাহলে তো ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মত ওনাদের ও নাম থাকতো।
আমি শুধু ওনাদের নাম শুনেছি , ইতিহাসের পড়া পড়তে গিয়ে মাঝে মধ্যে দুই এক লাইনের মধ্যে তাদের নামটাই শুধু লেখা থাকতো।কিন্তু আমি তাদের কাউকেই তেমন চিনি না ।কারণ তাদের নাম শুধু দু এক লাইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ।আমি শুধু একজনকেই চিনতাম।তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।কারণ
প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী , মৃত্যুবার্ষিকী, ৭ ই মার্চ সব অনুষ্ঠান হতো।সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম , এমনকি ২ বার বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ উপস্থাপন করে ইউনিয়ন পর্যায়ে পুরষ্কার ও পেয়েছি ।তিনি মহান , এইজন্যই সব জায়গায় শুধুই ওনার জয় জয়কার ।তাহলে সেই মহান ব্যক্তির মেয়ে ক্ষমতায় থাকবে না তো কে থাকবে ?
যাইহোক আম্মা - আব্বার এই কথাটা নিয়ে আমি আর ভাবলাম না ।অবশেষে নির্বাচন শেষ হলো , হাসিনা জয়ী হলেন ।
এভাবেই দিন কাটতে লাগলো ।
হঠাৎ একদিন জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে ,ফেইসবুকে কিছু পোষ্ট দেখতে লাগলাম। পোস্ট দেখতে দেখতে ভাবলাম আসল বিষয়টা কি ? একটি পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল "কোটা প্রথা নিপাত যাক,মেধাবীরা মুক্তি পাক" ।
তখন সেই পোস্টের কমেন্ট দেখলাম এবং ভাবলাম আসল বিষয়টা কি হতে পারে ? তারপর ইউটিউব থেকে আসল তথ্য জানলাম। তখন দেখলাম শিক্ষার্থীরা একটা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে , দাবিটি হলো তারা কোটা প্রথার সংস্কার চায় । আর তাদের এই আন্দোলন রুখতে ,পুলিশ ও ছাত্রলীগের লোকেরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর খুবই নির্মমভাবে নির্যাতন করছে ।এই নির্মম অত্যাচার আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ।কিভাবে মেয়েদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে এমনকি সবাইকে যেখানে পাচ্ছে সেখানেই মারছে।আমি নিজে জানি ,ছাত্রলীগ কতটা খারাপ ।কারণ আমি সিলেট জেলার একটা ছোট সরকারি কলেজে পড়ি।সেখানে রাজনীতির প্রভাব তেমন বেশি নেই ।এবং এখানকার জনগণ রাজনীতি নিয়ে ততটাও সচেতন নয় ।তবে ,প্রথম যেদিন কলেজে গেলাম সেইদিনই ছাত্রলীগের মারামারি দেখে আমি ভয় পেয়ে বাড়িতে চলে আসি।সে ঘটনা মনে করে ভাবতে থাকি,আমাদের এই ছোট কলেজে যদি ছাত্রলীগ এতটা ভয়ংকরভাবে নির্যাতন করে , তাহলে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কতটা ভয়ংকর নির্যাতন করবে? আর ছাত্রলীগের অতীত কতটা ভয়ংকর সেটা অনেক সময় বোঝা গেছে । ২০১৯ সালে একটা ছেলেকে সামান্য একটা স্ট্যাটাস এর জন্য পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে । ছেলেটি ছিল বুয়েটের আবরার ফাহাদ । তখন মনে মনে ভাবতে লাগলাম , শিক্ষার্থীরাই সঠিক আন্দোলন করছে । কারণ তারা তো কোটা প্রথার বাতিল চায় নি, সংস্কার চেয়েছে ।এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের সন্তানদের কোটা দেওয়া ঠিক আছে ।কিন্তু তাদের নাতি - নাতনীদের জন্য এই কোটার কি দরকার ? চাকরির ক্ষেত্রে ৫৬% কোটা থাকলে বাকি শিক্ষার্থীরা কি করবে ? এমনিতেই দেশে দিনদিন বেকারদের সংখ্যা বেড়ে চলছে । বেকারত্বের অভিশাপে অনেকেই আত্মহত্যা করছে ।
তখন থেকেই কেনো জানি মনটা অশান্ত হয়ে গেলো ।
তারপর পরের দিন হঠাৎ আবার ফেসবুক জুড়ে একটাই কথা দেখতে পেলাম , "তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার" ।
তখন আবার বিষয়টি জানতে গিয়ে দেখলাম , শেখ হাসিনা কোটার প্রশ্নে একটা ভিডিওতে বলছেন যে ,"কোটা মুক্তিযোদ্ধার নাতি পুতিরা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে" ? অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন ,যাদের দাদা - বাবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি তারা রাজাকারের বংশধর।
তখন আমিও ভেবে দেখলাম ,তাহলে আমিও রাজাকারের বংশধর ।
তিনি তখন সব শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি বলে উল্লেখ করেছেন ।
এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ,রাত্রিবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শোনা গেলো একটিই স্লোগান "তুমি কে আমি কে রাজাকার ,রাজাকার ।কে বলেছে কে বলেছে,স্বৈরাচার স্বৈরাচার "।
পর দিন থেকে এক এক করে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসলো। সারা বাংলাদেশ জ্বলে উঠলো ।
আন্দোলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ দিয়ে নির্যাতন করার পরও আন্দোলন থামলো না ।তখন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস ছাড়ার জন্য জোর করা হয় ।তখন দেখলাম একজন শিক্ষার্থী চিৎকার করে বলছে যে , "আমরা প্রয়োজনে লাশ হয়ে বের হবো তবুও ক্যাম্পাস ছাড়বো না " ।
তখন থেকেই, শেখ হাসিনা সম্পর্কে আমার সব ধারণা পাল্টে গেলো । নিজের বিবেক দিয়ে বিচার করে শিক্ষার্থীদের পক্ষে চলে আসলাম ।
তখন একটা পোস্ট দিয়েছিলাম শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যার জন্য অনেক হেনস্তার শিকার হয়েছিলাম।অন্যান্য শিক্ষার্থীদের অত্যাচারের তুলনায় আমার এই সামান্য সমস্যা কিছুই না ।
যাইহোক আমার কথা বাদই দিলাম ।
সেইদিন থেকে মনটা কেমন অশান্ত হয়ে উঠল।খবর দেখার অভ্যাস আমার নেই ।কখনোই আমি খবর দেখি না। দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা নিয়ে তেমন আগ্রহ আমার ছিল না ।কিন্তু ১৫ জুলাই থেকে প্রতিটি মুহূর্তই আমি শুধু খবরের অপেক্ষায় ছিলাম ।কখন কি হয় এসব দেখার জন্য । একটি একটি খবর সামনে আসলো আর দেখতে দেখতে আমি নিজেকে এক অজানা অচেনা পথে নিয়ে গেলাম ।জানি না আমি কেনো সেই শিক্ষার্থীদের জন্য এতটা মায়া অনুভব করলাম ।তারা তো আমার চেনা পরিচিত কেউই নয় । তাহলে তাদের জন্য আমার মন এতটা আকুল কেনো হচ্ছে ? মনে মনে তাদের জন্য দোয়া চাইলাম যেনো, তাদের উপর আর কোনো অত্যাচার না হয়।
১৬ জুলাই ২০২৪।
প্রতিদিনের মত আজকেও আমি নিজের ফোনটা হাতে নিলাম ।তখনই একটি খবর দেখতে পেলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র আবু সাঈদ কে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে । গুলি করার আগ মুহূর্তে ও সে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল ।
এই দৃশ্য টা দেখে , আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে, নিজের দেশের পুলিশ নিজের দেশের ছাত্রকে গুলি করে কিভাবে মারতে পারে ।তখন মনে পড়ে , বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম যে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম , বরকত ,রফিক ,জব্বার আরও অনেকেই ।কিন্তু তখন তো অন্য দেশের পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।আর এবার নিজের দেশের পুলিশই নিজের দেশের ছেলেকে গুলি করলো কিভাবে ?
আমার এই চঞ্চল মন কিছুতেই এটার হিসাব মেলাতে পারছে না ।
যখন খবর দেখলাম , সাঈদের পরিবারের অসহায়ত্ব আর কান্না দেখে তখন নিজের অজান্তেই দুচোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো বুঝতেই পারলাম না । আবু সাঈদ ভাইয়ের বোন কিভাবে কান্না করে চিৎকার করে বলছে , "আমার ভাই এত মেধাবী ছিল , কেনো তাকে গুলি করে হত্যা করলো ।আমি বিচার চাই "।আর মা তো বোকা হয়ে গেছেন ,নিজের বুকের ধনকে নিজের চোখের সামনে চিরতরে শুয়ে থাকতে দেখছেন সেই সময় মায়ের মনের অনুভূতি কেমন ছিল সেটা মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না ।বাবা তো বারবার নিজের ছেলেকে কিভাবে কষ্ট করে বড় করেছেন সেই কথা বলছেন আর দু চোখ দিয়ে পানি ফেলছেন ।ভাইটা তো ,বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে,এই দৃশ্য যে দেখেছে সেই বুঝবে কতটা কষ্টদায়ক।কিন্তু সে মানুষটা যদি স্বৈরাচারী মনোভাবের অধিকারী আর ক্ষমতার লোভী হয় তাহলে কখনোই বুঝবে না ,যে আপন মানুষ হারানোর কষ্ট কেমন ।তখন মনের ভেতর কেমন জানি , বেদনাদায়ক অবস্থার সৃষ্টি হলো ।মনে মনে ভাবলাম , শেখ হাসিনা নিজের বাবার মৃত্যুর কষ্ট নিজের পরিবার হারানোর কষ্ট ৫০ বছর ধরে ভুলতে পারে নি । তাহলে এই মায়েরা কিভাবে তাদের তরুণ ছেলেদের মৃত্যু সহ্য করবে ? এইরকম হাজার প্রশ্ন মনের ভিতর জমাট বাঁধে।
আমি ভাবতে লাগলাম , এই বিচার কি হবে ? সবাই কি আবু সাঈদের খুনীর বিচার চাইবে ? সরকার কি এই বিচার করবে ? তখন মনে পড়লো সরকার কেনো বিচার করবে ? সে নিজেই তো আবু সাঈদকে মেরেছে ।
কারণ সে ভেবেছে যে, একজনকে মেরে ফেললে বাকি সবাই ভয়ে চলে যাবে ।কিন্তু ঠিক তার উল্টোটা হলো । অবিশ্বাস্যভাবে , সারা বাংলাদেশ গর্জে উঠলো ।
ধীরে ধীরে ,শিক্ষার্থীরা ছুটে আসলো আবু সাঈদের বিচার চাইতে ।এতদিন যারা ঘরে বসেছিল তারাও স্লোগান নিয়ে বের হলো ।
"আমার ভাই মরলো কেনো ? বিচার চাই বিচার চাই "
রাস্তায় রাস্তায় শিক্ষার্থীদের ঢল নেমে গেলো ।সবার একটাই দাবি, আবু সাঈদ হত্যার বিচার করতেই হবে ।
আমি এখন একটা নতুন চেতনা দেখলাম ।দেখলাম যে , এই যুগের শিক্ষার্থীরা ও একে অপরের জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করতে পারে। হ্যাঁ আমি বুঝলাম , যে এখনকার শিক্ষার্থীরাও নিজেদের অধিকার চাইতে পারে ।নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে পারে ।নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাজপথে রক্ত ঢেলে দিতে পারে। এইরকম ঘটনা জন্মের পর আমি এই প্রথম দেখলাম।
১৬ তারিখ দিনটা খুবই দুঃখও কষ্টে কাটলো।দেশের অবস্থা ভালো না।
তারপর এভাবেই খবর দেখতে দেখতে আর অশান্ত মন নিয়ে থাকতে লাগলাম ।হঠাৎ ১৭ তারিখ দিনে অনেক খবর দেখলাম তাদের মধ্যে কিছু ছেলে ও মেয়েদের দেখলাম যারা বলছে যে ' দরকার হলে লাশ হয়ে বেরুবো তবুও আমরা ক্যাম্পাস ছাড়বো না ' । তাদের 2 চোখ ছিল অগ্নির মত লাল ।কারণ সেই চোখে টিয়ারশেল পড়েছিল ।আমি তাদের চিনতে পারি নি। শুধু বারবার একটা কথা শুনেছি , তারা নাকি সমন্বয়ক ।কিন্তু সমন্বয়ক কি ? কিসের সমন্বয়ক ? সেটা বুঝতে পারলাম না।
হঠাৎ রাতে নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যায় ।ভাবলাম হয়তো কোনো সমস্যা হয়েছে ঠিক হয়ে যাবে ।কিন্তু রাত টা কাটলো না। সারারাত মনের ভিতর অহরহ চিন্তা জাগতে লাগলো ।অনেক প্রশ্ন ছিল মনের ভিতরে ।যেগুলোর অনেক উত্তর জানা ও অজানা ছিল ।
পরের দিন ,সকালে উঠে জানতে পারলাম সরকার কারফিউ জারি করেছে ।কেউ ঘর থেকে বের হবার সাহস পাচ্ছে না ।তখন বুঝলাম সত্যিই দেশের অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেছে ।
তারপর আমার বান্ধবী আমাকে ডিরেক্ট কল দিলো ।বললো যে , দেশের মধ্যে অনেক মারামারি হচ্ছে অনেক লোককে মারা হচ্ছে ।পুলিশ নির্বিচারে গুলি করে অনেক লোক মারছে।
আমি বললাম , "ইন্টারনেট কবে দিবে" ?
ও বললো যে ,"সেটা কেউই জানে না । শিক্ষার্থীরা নাকি ডেটা সেন্টার পুড়িয়ে দিয়েছে" ।
আমি মনে মনে ভাবলাম কিসের জন্য এমন হলো ? তারপর ভাবলাম হাসিনা হয়তো ইন্টারনেট বন্ধ করে নিজের কুকর্ম ঢেকে রাখতে চাইছে আর দেশের ভিতর হত্যা চালাচ্ছে যাতে দেশের মানুষ কিছুই জানতে না পারে ।
তখন মনটা আরো অস্থির হয়ে উঠল , মনে মনে ভাবলাম আল্লাহ , হয়তো কত মানুষ মরছে ।
২০ তারিখ আমার বান্ধবী কল দিয়ে বললো,যে আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে ।তখন আমিও বললাম আয় চল আমরা দুজন অংশগ্রহণ করি। তখন আমরা আম্মা আব্বাকে বললাম যে , আমাদের এখানে আন্দোলন হবে না আর এই শহরে তেমন কিছুই হচ্ছে না সবকিছু ঠিকঠাক চলছে ।এই বলে চললাম কলেজের দিকে ।কলেজে যাবার পরেই , ছাত্রলীগের কিছু ছেলে এসে আমাদের সবাইকে বাধা দিলো এবং যাকে সামনে পেলো মারতে লাগলো। পুলিশরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল কিন্তু কিছুই করলো না ।এরপর তারা এমন ভয়ঙ্কর নির্যাতন করলো যে ,এরপর আর কেউ আন্দোলনে আসলো না । এখানেই আমাদের আন্দোলন থেমে গেলো ।এর পর অনেক আফসোস করতে লাগলাম ,মনে মনে ভাবলাম " ইশ !যদি ঢাকা ,চট্টগ্রাম বা রাজশাহী এইসব জেলায় আমার বাসা হতো তাহলে আমিও এই আন্দোলন অংশগ্রহণ করতে পারতাম "।
এভাবেই ঘরের মধ্যে বন্দি দিন কাটতে লাগলো ।বারবার শুধু ফোনটা হাতে নিয়ে ডাটা অন করতাম আর দেখতাম নেটওয়ার্ক আসছে কি না ।কিন্তু নেটওয়ার্ক আসলো না ।
এভাবে একদিন ,২ দিন ,৩ দিন চলতে চলতে লাগলো। অবশেষে ১১ দিন পর নেটওয়ার্ক আসলো ।কিন্তু নেটওয়ার্ক খুবই ধীর গতিসম্পন্ন ।
ইউটিউবে ঢুকতেই দেখি , মৃত্যু আর মৃত্যুর খবর । কোনটা রেখে কোনটা দেখব সেটাই ভাবতে পারছি না।
একটা ছেলে আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের পানি ও বিস্কুট দিতে গিয়ে মাথায় গুলি খেয়ে শহীদ হলো ,নাম ছিল তার মুগ্ধ । মুখ জুড়ে ছিল ,হাসি আর হাসি।ফারহান ,জাফর, তাহমিদ,মারুফ,সাগর ,রনি ,নাইমা, জিল্লুর ,ইব্রাহিম,রতন,দীপ্ত,রাব্বি,ইসমাইল, আরো শত শত শিক্ষার্থী ও মানুষ মারা গেছে ।
আনাস নামক একটি ছেলে ,মাকে চিঠি লেখে গিয়ে শহীদ হয়েছে । চিঠিতে ছিল , "যদি মরে যাই মা তবে গর্বিত হইয়ো" ।নাফিস ,গুলি খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রিকশায় ছিল তবুও তার চিকিৎসা করতে দেওয়া হয় নি।
তখন ভাবলাম হায়রে নির্মমতা ।এত নির্মম মানুষ কিভাবে হতে পারে। শুধু তাই নয় ,যারা মানুষ বাঁচানোর জন্য ডাক্তার হয়েছেন, সেই অধিকাংশ ডাক্তাররা এইরকম অবস্থায় সাহায্য করে নি চিকিৎসা দেয় নি।কিন্তু সেই সময় পাশে ছিল , অশিক্ষিত কৃষক, শ্রমিক,ভ্যানচালক, রিকশাচালক ।এছাড়াও হেলিকপ্টার থেকে করা হয় ,এবং সেই গুলিতে ঘরের মধ্যে সামির নামক একটি বাচ্চা গুলি খেয়ে মারা যায় ,ছাদে খেলতে গিয়ে বাচ্চা মেয়ে রিয়া মারা যায় ,আহাদ ও হোসাইন সহ আর অনেক বাচ্চা মারা যায়। ইয়ামিন নামক একটা ছেলেকে ,গুলি করে জীবিত থাকা অবস্থায় গাড়ি থেকে নির্মম ভাবে ফেলে রাস্তার ওপর পাশে টেনে হিঁচড়ে ফেলে দিয়ে আসে ।এভাবে এইরকম হাজার হাজার ভিডিও আসতে থাকে ।সাংবাদিক প্রিয় ভাইকে হত্যা করার পরেও তার অবুঝ মেয়েটি এখনো বাবার অপেক্ষা করছে ।ছোট ভাইয়ের লাশ নিয়ে বড় ২ বোন রাস্তায় মিছিলে নেমে এসেছে। নিজের ছেলের লাশ বাবা নিজের রিকশায় করে নিয়ে এসেছেন । ভাইয়ের কোলে বোনের লাশ ছিল ।
বন্ধুকে বাঁচাতে নিজেই গুলি খেয়ে মরে যাচ্ছে তবুও পিছপা হয় নি ।বউয়ের গর্বে, বাচ্চা রেখে গুলি খেয়ে শহীদ হয়েছেন আল আমিন ভাই ।একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা শত শত মা - বাবা ।মৃত্যুর বিচার চাইতে মা বাবা রাস্তায় নেমে এসেছে ।রাস্তায় যাকে পাচ্ছে ফোন চেক করছে , ফোনের মধ্যে কোটা আন্দোলনের পক্ষে কোনো পোস্ট বা ছবি পেলে তাকে টেনে হিঁচড়ে জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছে ।হাজার হাজার মানুষের সামনে থেকে যাকে পাচ্ছে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে ।কথা বলতে দিচ্ছে না ,মুখ চেপে ধরছে ।এখন এই আন্দোলন আর ছাত্রদের নয় ,
এখন এই আন্দোলন পুরো দেশবাসীর আন্দোলন হয়ে গেছে।এভাবেই রাজপথে শহীদ হয়েছেন , রিকসাওয়ালা ,কৃষক,শ্রমিক,চাকরিজীবী, বাচ্চা , যুবক,কিশোর,কিশোরী ,শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণীর মানুষ ।
এখন স্বৈরাচারের দোসর গুলো ছাড়া সবাই রাজপথে ।সবাই যার যার জায়গা থেকে এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শুরু করলো ।আমাদের প্রবাসী ভাইয়েরা রেমিটেন্স দেওয়া বন্ধ করে দিলো ।সাধারণ জনগণ , বিদ্যুৎ বিল ,গ্যাস বিল সব কিছু বন্ধ করে দিলো ।
তাছাড়াও খবরে শোনা গেলো যে , শিক্ষার্থীরা নাকি মেট্রোরেল ধ্বংস করে ফেলেছে ।এই অপরাধে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে নিয়ে অত্যাচার করা হচ্ছে কিন্তু এসবকিছু হাসিনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করছে ।
এভাবেই ভিডিও দেখতে দেখতে একটা ভিডিও দেখলাম যে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলছে "একটা মারলে একটা যায় বাকিটি যায় না স্যার " । তখনই আমি বুঝলাম এই আন্দোলন আর থামবে না যতক্ষণ না এই হাসিনার পতন হবে।
এভাবেই চলতে থাকে,এই সব কিছু ।কিন্তু ১১ দিনের হত্যাযজ্ঞ কোনো মিডিয়াই সঠিকভাবে প্রচার করে নি।কিন্তু যমুনা টেলিভিশন সবার থেকে বেশি সত্য প্রচার করেছিল । তার পর একদিন কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা হলো ।কিন্তু তাতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থামায় নি ।কারণ তারা অধিকার চাইতে গিয়েছিল লাশ হয়ে ফিরেছে । তাই তারা এখন এই হত্যার বিচার চায় ।প্রয়োজনে লাশ হবে তবুও বিচার নিয়ে যাবে ।তার পর ফ্যাসিস্ট হাসিনা মেট্রোরেল এবং বিটিবি ভবন দেখতে গিয়ে কান্না করেছে ।এই ভিডিও দেখার পর কি আর বলব। বলার কোনো ভাষা নেই।হাজার হাজার মানুষকে খুন,গুম আর আহত করার পরেও যার চোখে বা মুখে একটুও অনুশোচনা নেই।সেই খুনি সামান্য একটা স্থাপনার জন্য চোখের জল ফেলছে । এতেই বোঝা যাচ্ছে যে,তার কাছে মানুষের জীবনের চেয়েও স্থাপনার মূল্য বেশি । হায়রে মানুষ।
হাসিনা এই আন্দোলন থামানোর জন্য অনেক কিছু করছে । বিগত ১৬ বছর ধরে যেভাবে পাপ ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল সেভাবে এই আন্দোলনেও একই কাজ করছে ।
এর পূর্বে একটানা ১৫ বছর সে ক্ষমতায় ছিল ।এই ১৫ বছরে সে এই বাংলাদেশে নিজের স্বৈরাচারী শক্তিকে এতটা শক্তিশালী করেছিল যে , তার বিরোধী কোনো শক্তি বা রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে লড়াই করা তো দূর, কথা বলার সাহস পর্যন্ত পায় নি। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সব ক্ষেত্রে শুধুই তার রাজত্ব ছিল ।তার এই রাজত্বে দুঃশাসন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।তার দুঃশাসনের জন্য দেশের সাধারণ জনগণ ,আলেম সমাজ , শিক্ষিত সমাজ এমনকি গণমাধ্যমের ব্যক্তিরাও তার কোনো সমালোচনা করার সাহস পেত না ।কারণ , কেউ তার কোনো ভুল বলে দিলে কিংবা তার সমালোচনা করলে সে আর কখনোই বেঁচে থাকতে পারতো না ।মিথ্যে মামলা দিয়ে সে দেশের গণমান্য কত ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়েছে সেটার কোনো হিসাব নেই ।নিজের ক্ষমতা লাভের জন্য সে কত হাজার মানুষ মেরেছে তার কোনো হিসাবই নেই।নিজের ক্ষমতার জন্য ,বারবার গণহত্যা করেছে ।বারবার অবৈধভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে ।দেশের যোগ্য লোকদের রেখে অযোগ্য লোকদের সে ক্ষমতায় বসিয়েছে যাতে তারা তার গোলামী করে । দেশ থেকে অঢেল টাকা ও সম্পদ বিদেশে পাঁচার করেছে তার কোনো হিসাব নেই ।পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে ।দেশের অর্থনীতি কে অচল করে ফেলেছে ।তবুও তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো হয় নি। আর যারা এই সাহস দেখিয়েছে তারা চরম নির্মমতার শিকার হয়েছে। সে এই দেশকে নিজের বাবার দেশ বলে আখ্যায়িত করেছে ।এই দেশ যারা সৃষ্টি করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। তাদের কোনো অস্তিত্ব সে রাখেনি ।এমনকি এখনকার অধিকাংশ ছেলেমেয়েরা সেইসব লোকদের নাম পর্যন্ত জানে না , আমি নিজেও তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।অবাক হবার কিছুই নেই হাসিনা এটাই চাইতো যে ,এই জাতি অন্ধ থাকুক অশিক্ষিত থাকুক যাতে তার পাপের রাজত্ব কেউ ধ্বংস করতে না পারে ।পাঠ্যপুস্তকে , ম্যাগাজিনে ,অফিস- আদালতে এমনকি দেশের সবজায়গায় নিজের বাবাকে সকল শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হিসেবে তুলে ধরেছে ।সে এই জাতিকে অন্ধ রাখতে সবকিছুকে ধ্বংস করে দিয়েছে ।দেশের মানুষ , দেশের ছাত্রসমাজ তার উপর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল কিন্তু কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারে নি।
বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীরা কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলনে নেমেছিল কিন্তু হাসিনা ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেটাকে বারবার থামিয়ে দিয়েছে ।কিন্তু এবার একজন নেতৃত্ব দেয় নি।অনেকেই নেতৃত্ব দিয়েছিল ।এবারে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের কে সবাই সমন্বয়ক বলে চিনতো। আন্দোলনের শুরুতে তাদের দেখেছিলাম কিন্তু তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।
ভিডিও দেখতে দেখতে চিনতে পারলাম সমন্বয়ক কারা।তাদের নাম ও তাদের আত্মত্যাগের কথা ।তখন তাদের দেখে গর্বিত হলাম ।এবং নিজের মনের ভিতরের সব ভুল ধারণা ভেঙে গেলো।ভাবলাম , নেতৃত্ব দিতে হলে আসিফ , নাহিদ, সারজিস,হাসনাত , হান্নান ,রাফি ,বাকের,তাবাসসুম,উমামা সহ অন্যান্য আরো অনেক সমন্বয়ক দের মত বিশ্বাসী আর সাহসী নেতৃত্ব দেওয়া দরকার ।কারণ তাদের প্রতি শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস ছিলো বলেই তাদের ডাকে রাজপথে জীবন ঢেলে দিয়েছে ।আর তারাও সেই রক্তের মূল্য দেবার জন্য বারবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে কিন্তু তবুও ফিরে আসেনি ।শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করে নি।আমি রাফি ভাইকে দেখেছি কিভাবে পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল । আমি হাসনাত ভাইকে দেখেছি কিভাবে পুলিশের সাথে লড়াই করেছিলেন । আমি আসিফ ও নাহিদ ভাইয়ের আহত সেই শরীরকে দেখেছি তবুও তারা ফিরে আসে নি। আমি সারজীস ভাইয়ার সেই ক্ষোভে জ্বলে উঠা রক্তচক্ষুকে দেখেছি যেই চোখগুলো শত্রুদের আস্তানায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ।আমি বাকের ভাইয়ার সেই সাহসে ভরা মুখটি দেখেছি ।আমি হান্নান ভাইয়ার চোখ ভেজা কান্না দেখেছি ।আমি নুসরাত , মিতু , উমামা দের সেই সাহসী বক্তব্য আর সাহসী পদক্ষেপ গুলো দেখেছি । তাই আমি বুজেছি এরাই আসল নেতা। এদের কেউ কিনতে পারবে না।
শেখ হাসিনা ভেবেছিল ,প্রতিবারের মত এবারও নেতৃত্ব দেওয়া সবাইকে থামিয়ে দিতে পারলে সে জয়ী হবে ।এইজন্য এটা ভেবে সে নুরুল হক নুর ভাইকে নিয়ে রিমান্ডে দেয় ।
পরে সমন্বয়ক সবাই ৬ দফা দেয় কিন্তু হাসিনা তা মেনে নেয় নি। তারপর ৯ দফা দেওয়া হয় সেটাও হাসিনা মেনে নেয় নি।
তার পর এই আন্দোলন এক দফায় চলে যায় ।
স্লোগান সারা দেশ জুড়ে একটাই " দাবি এক দফা এক,
শেখ হাসিনার পদত্যাগ,,
১'২'৩'৪ হাসিনা তুই গদি ছাড়"
পুরো দেশ এখন উত্তাল হয়ে উঠে ।
সবাই সবার মনের ক্ষোভ আর রাগ নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। এভাবেই আন্দোলন চলতে থাকে।
পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায় যে ,হাসনাত, সারজিস,আসিফ,নাহিদ, বাকের ও তাবাসসুম এই ছয় সমন্বয়কদের ডিবি অফিসে নেওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাদের নিরাপত্তার জন্য এখানে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু আমার মনে বারবার প্রশ্ন জাগছে , তাদের কে কি আর পাওয়া যাবে ? তাদের কে হয়তো শেখ হাসিনা মেরে ফেলবে ।পরের দিন ভিডিও দেখলাম ,এবং তারা ডিবি প্রধান হারুনের সাথে এক টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে । পরে জানিয়েছে যে ,তারা এই আন্দোলন স্থগিত এখানেই স্থগিত করছে ।
কিন্তু তবুও শিক্ষার্থীরা এই কথা মেনে নেয় নি।তারা বুঝে গেছে যে সমন্বয়ক দের উপর চাপ প্রয়োগ করে এসব বলানো হয়েছে ।আমিও সেটা স্পষ্ট বুঝেছি ।
কারণ যারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছিল তারা কখনও এইরকম করতে পারবে না।
তারা আন্দোলন থামায় নি।উল্টো আন্দোলন আরো বেশি বেড়ে যায় ।এবং এভাবেই আন্দোলন চলতে থাকে ।
৩ তারিখ সমন্বয়ক দের মুক্তি দেবার পরেই তারা জানান যে ,এই আন্দোলন স্থগিত করার কথা তাদের কে জোরপূর্বক বলানো হয়েছে ।তখন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন ।
পরে তারা "লং মার্চ টু ঢাকা " দেয় ।
যার ফলে আন্দোলন এখন পুরোপুরি বেড়ে যায়। এবং ঘোষণা দেওয়া হয় , পরশু নয় আগামী কালই লং মার্চ টু ঢাকা " ।
এই সিদ্ধান্তই ছিল চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
তারপর আবার নেটওয়ার্ক চলে যায়।তখনই আমি বুঝলাম যে সত্যিই এখন আরো বড় কিছু হবে ।হয়তো শেখ হাসিনা সবকিছু শেষ করে দিবে ।
তারপর সবাই , গণভবনের দিকে রওয়ানা দিলো ।
চারিদিকে গুলি করে পাখির মত মানুষ মারা যাচ্ছে ।কিন্তু তবুও তারা থামছে না ।
তখন শেখ হাসিনা নিজের গদী বাঁচানোর জন্য সর্বশেষ চেষ্টা করে।সে সেনাবাহিনীকে হুকুম দেয় ,গুলি করার জন্য ।কিন্তু তারা এটা করে নি।তারা পুলিশদের মত বিক্রি হয়ে যায় নি।তারা তাদের জীবন জনগণের কল্যাণে ঢেলে দিয়েছে এবং অবশেষে ৫ আগষ্ট দুপুরবেলা শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় তার আপন দেশ ভারতে। তার সব নেতা কর্মীদের মধ্যে অনেকে চলে যায় এবং তার পুলিশ বাহিনীর সবাই পালিয়ে যায়।
এত হত্যা , এত গুম খুন করেও ঠিকতে পারে নি।কারণ সত্যের জয় সবসময় হয় ।আর জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।এইজন্যই মাত্র ৩৫ দিনে হাসিনার এত শক্তিশালী পাপের রাজ্য ধ্বংস করে দিলো ।
এভাবেই শেষ হয় ১৬ বছরের অত্যাচার, নিপীড়ন আর হত্যাযজ্ঞের রাজ্য।
হাসিনা চলে যাবার পর ,
পুরো দেশ বাসী মেতে উঠে আনন্দে।নতুন স্বাধীনতা কে তারা মন থেকে বরণ করে নেয় ।
শিক্ষার্থীরা সব কিছু নতুন করে সামলায় ।
এবং ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছে ।
ডাকাতদের মোকাবেলা করেছে ।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিয়েছে ।
তারপর হাসিনার একের পর এক কুকীর্তি ফাঁস হতে লাগলো । অবৈধ নির্বাচন , শাপলা চত্বরের গণহত্যা , পিলখানা হত্যাকান্ড ,মিথ্যা মামলায় অসংখ্য মানুষকে জেল খাটানো , আয়না ঘর সহ্ আরও অনেক অনেক কুকীর্তি বের হয় যেগুলো বলে বোঝানো যাবে না ।
এখন এই আন্দোলনের প্রায় ৫ মাস হতে চললো।
দেশে নতুন অন্তবর্তী কালীন সরকার গঠন করা হয়েছে ।
কিন্তু এখনো আমার হাজার হাজার আহত ভাই হাসপাতালে হাহাকার করছে ।তাদের এই আত্মত্যাগের কথা শুনলে মন অশান্ত হয়ে উঠে ।
আমাদের এই জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া পরিবারের লোকদের আহাজারি গুলো যত দেখি ততই চোখ জুড়ে কান্না আসে ।
শেখ হাসিনার এই পাপ এর হিসাব কখনোই দেওয়া সম্ভব না। দেশটাকে এত ধ্বংস করার পরেও সে থামেনি
এখনো ভারত থেকে দেশে অনেক অশান্তি সৃষ্টি করছে ।গুজব ছড়াচ্ছে ।এমনকি হুমকি দিচ্ছে ।
আমার শহীদ ভাইদের নামে মামলা দিচ্ছে ।আহত দের দলীয়করণ করছে ।সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে ভারতের সাথে কলহ সৃষ্টি করছে।
এই পিশাচিনি কখনও নির্লোভ হতে পারবে না ।যতদিন না পর্যন্ত তার পর্যাপ্ত শাস্তি হবে।
এখনো কিছু মানুষ নির্লজ্জের মত আওয়ামী লীগের সাফাই গায়।আওয়ামী লীগ কে ক্ষমতায় রাখতে চায় ।তারা এই শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করতে চায় ।কিন্তু আমার বিশ্বাস এই দেশের ছাত্রজনতা এইরকম হতে দিবে না প্রয়োজনে আবারো জীবন দিবে তবুও এই দেশে স্বৈরাচারের জায়গা হতে দিবে না ।
আমি মনে করি ,শেখ হাসিনা নিজের পতনের জন্য নিজেই দায়ী। ১৯৭১ সালের শহীদদের প্রবিত্র রক্তকে সে পুঁজি করে তার বাবার মতো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে ।বারবার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ।আয়নাগঘর নামক একটি জায়গার মধ্যে কত নির্মমতা চালিয়েছে সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না ।
সে যদি আন্দোলনের প্রথমেই এই দাবি মেনে নিত তাহলে আজ সে দেশ ছাড়া হতো না।
সে যদি ৬ দফা বা ৯ দফা মেনে নিত তাহলে আজ এইরকম হতো না ।
আজ তার জন্য মানুষ আওয়ামী লীগ নামক দলকে এতটাই ঘৃণা করে যে কেউ বলে বোঝাতে পারবে না।
তবে হ্যাঁ , আমি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের একজন জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ ।আমি দেখেছি কিভাবে আমার নির্দোষ ভাই বোনদের হত্যা করা হয়েছে ।বিনা অপরাধে আটক করা হয়েছে ।কিভাবে আমার হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করেছে ।কিভাবে আমার শহীদ ভাইদের অবুঝ বাচ্চাগুলো এখনও বাবার অপেক্ষা করছে ।কিভাবে আমার হাজার হাজার ভাইকে আহত করেছে আজও তারা হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছে। তাদের কারো হাত নাই , কারো চোখ নাই , কারো নাক নাই , কারো মেরুদন্ড নাই।তাদের সাথে অসহায় হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মা বাবা ।পরিবারের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যমকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে।
অনেক শিশু তাদের মা বাবার মুখটি পর্যন্ত দেখতে পারে নি।এর থেকে নিসংশতা আর হতেই পারে না ।
এখন আমাদের দায়িত্ব এই দেশকে পুনর্গঠন করা ।দেশের কল্যাণে নিজেকে নিজের জায়গা থেকে নিয়োজিত করা। ক্ষমতার লোভ না করে জনতার জন্য কাজ করা ।এবং মনে রাখবেন , শেখ হাসিনা চলে গেলেও তার ছোটখাটো চামছাগুলো এখনও অলিতে গলিতে রয়ে গেছে ।তারা এখন গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদেরকে সরাতে হবে ।কারণ তাদের জন্য এই দেশের মানুষ অশান্তিতে ভুগছে ।
আর শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরে যে ক্ষতি করেছে সেই ক্ষতিপূরণ করতে অনেক সময় লাগবে। তাই আমাদের উচিত রাষ্ট্র সংস্কারে একত্রে কাজ করা এবং দলের থেকে দেশকে বড় করে দেখা ।
এবং সারাজীবন এই চব্বিশের জুলাই মাসকে স্মরণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ।হ্যাঁ , আবু সাঈদের বুলেটের সামনে বুক পেতে দেওয়ার দৃশ্য আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে জীবনকে বিলিয়ে দেওয়া যায় । জুলাই আমাকে শিখিয়েছে দেশের সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে এই দেশ কতটা এগিয়ে যেতে পারবে ।আমাদের দেশ বাংলাদেশ ।আমরা আমাদের শহীদ ভাইদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি ।এবং আল্লাহ যেন আমার সব ভাইদের পরিবারের লোকদের ধৈর্য দেন। আমার আহত ভাইদের যেনো সুস্থতা ও মনের ভেতর শক্তি দেন ।
জানালার পাশে বসে আছি ।বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছি ।আকাশটা কালো মেঘে অন্ধকার। এক ফোঁটা বৃষ্টিই পারে এই অন্ধকার আকাশকে আলোকিত করতে ।
অন্ধকার আকাশ দেখতে দেখতে মনে পড়লো সেই জুলাইয়ের অন্ধকার দিনগুলোর কথা ।আজও স্পষ্ট মনে আছে সেই ৩৬ টি দিনের কথা ।আজও চোখ বন্ধ করলে মনে পড়ে কিছু দৃশ্য আর কিছু হাহাকার । কান পাতলেই শুনতে পাই কিছু কন্ঠ ।এসব মনে পড়লে মন অশান্ত হয়ে যায় ।
দুচোখ জুড়ে ঘুম আসে না ।মনে হয় , এখনও সেই অন্ধকার কাটে নি।মনে হয় এখনও অনেক কঠিন পথ পার হওয়া বাকি আছে ।মনে হয় এখনও রক্তের দাম আমরা শোধ করতে পারি নি।এখনও অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারি নি।এখন ও মনে হয় ,আকাশের মধ্যে নতুন শকুনের দল এসেছে আকাশ দখল করতে ।যারাই আসুক না কেন এই স্বাধীনতা এত সহজে কেড়ে নিতে দিব না ।কারণ এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কতটা সংগ্রাম আর আত্মত্যাগ করেতে হয়েছে সেটা কিছু স্বার্থপর দল , আর ক্ষমতালোভী মানুষ এই আত্মত্যাগের মূল্য না দিলেও আমরা আমাদের জীবন দিয়ে হলেও এই আত্মত্যাগের মূল্য দিবো ।
সবশেষে একটা কথা বলে শেষ করতে চাই ,
"দিয়েছি তো রক্ত "
আরও দেবো রক্ত ।
রক্তের বন্যায়
ভেসে যাবে অন্যায়।
আবু সাঈদ, মুগ্ধ
শেষ হয়নি যুদ্ধ।
যে বা যারা এই জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি বা ইতিহাস মুছে দিতে চাইবে। আমরা Generation -Z জীবন দিয়ে দিব তবুও এই ইতিহাস মুছতে দিব না ।
[বি দ্রঃ বানান বা বিরামচিহ্ন গুলোতে কোনো ভুল হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]