Posts

গল্প

পাহাড়ের কোলে এক অচেনা সুর

April 18, 2025

MD SHAHIN

161
View

পার্বত্য চট্টগ্রামের এক প্রত্যন্ত গ্রাম, কালেঙ্গা। চারপাশে সবুজ পাহাড়, মাঝে মাঝে বাঁশের সাঁকো আর কচুরিপানায় ঢাকা ছোট্ট খাল। এখানে বাস করে রাখি, এক দরিদ্র ত্রিপুরা পরিবারের মেয়ে। বাবা-মা দুজনেই জুম চাষ করেন, কিন্তু বর্ষায় পাহাড়ের মাটি ধসে তাদের স্বপ্নও ভেসে যায়। রাখির বয়স মাত্র চৌদ্দ, কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত জেদ আর কৌতূহল।

রাখির পরিবারের কাছে বেঁচে থাকাটাই যুদ্ধ। বাড়িতে চাল নেই, কেরোসিন নেই, তবু রাখি হাসে। তার একটা অদ্ভুত শখ—পাহাড়ের শব্দ শোনা। সে বিশ্বাস করে, পাহাড়ের গাছ, পাথর, আর ঝরনার মধ্যে একটা গান লুকানো আছে। প্রতিদিন ভোরে, যখন তার মা তাকে কাঠ কুড়োতে পাঠায়, রাখি পাহাড়ের গভীরে চলে যায়। সেখানে সে কান পেতে শোনে—পাখির ডাক, পাতার মর্মর, আর দূরের কোনো ঝরনার কলকল। এই শব্দগুলো তার কাছে একটা গল্প বলে, যা কেউ শোনে না।

একদিন, পাহাড়ে কাঠ কুড়োতে গিয়ে রাখি একটা ভাঙা বাঁশি পায়। কোনো পথিক হয়তো ফেলে গেছে। বাঁশিটা ময়লায় মাখা, কিন্তু রাখির কাছে সেটা যেন কোনো রাজকীয় উপহার। সে বাঁশিটা পরিষ্কার করে, আর নিজের মনের মতো ফুঁ দেয়। প্রথমে শুধু ফিসফিস শব্দ, কিন্তু কয়েকদিন চেষ্টার পর বাঁশি থেকে একটা সুর বেরোয়। সে সুরে পাহাড়ের শব্দ মিশে যায়—ঝরনার কলতান, পাখির ডাক, আর বাতাসের গান।

গ্রামের মানুষ প্রথমে রাখির বাঁশির শব্দ শুনে হাসাহাসি করে। “ওই পাগলি মেয়ে আবার কী শুরু করলো!” কিন্তু রাখি থামে না। সে প্রতি সন্ধ্যায় পাহাড়ের চূড়ায় বসে বাঁশি বাজায়। তার সুরে একটা জাদু আছে। ধীরে ধীরে গ্রামের বাচ্চারা তার কাছে জড়ো হয়। তারা শোনে, মুগ্ধ হয়। এমনকি বুড়ো মংলু চাচাও, যিনি কখনো হাসেন না, একদিন রাখির সুর শুনে চোখের কোণে জল ফেলেন।

একদিন খবর আসে, শহর থেকে কিছু লোক গ্রামে আসছে। তারা পার্বত্য এলাকার সংস্কৃতি নিয়ে একটা উৎসব করতে চায়। গ্রামের মানুষ তাদের নাচ, গান, আর জুম চাষের গল্প দেখাতে প্রস্তুত হয়। কিন্তু রাখি কিছু বলে না। সে শুধু তার বাঁশি নিয়ে পাহাড়ে চলে যায়।

উৎসবের দিন, সবাই যখন নাচ-গানে মেতে উঠেছে, রাখি হঠাৎ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বাঁশি বাজাতে শুরু করে। তার সুর ভেসে যায় পুরো উপত্যকায়। শহরের লোকেরা থমকে দাঁড়ায়। একজন বলে, “এটা কী সুর? এ যেন পাহাড়ের আত্মা কথা বলছে!” তারা রাখির কাছে ছুটে যায়, তার গল্প শোনে। রাখি লাজুক হাসিতে বলে, “আমি তো শুধু পাহাড়ের কথা বাজাই।”

সেই উৎসবের পর রাখির নাম ছড়িয়ে পড়ে। শহরের একটি সংগীত দল তাকে তাদের সঙ্গে বাজাতে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাখি রাজি হয় না। সে বলে, “আমার গান এই পাহাড়ের জন্য। এখানেই থাকবো।” তবে সে একটা শর্ত দেয়—তার গ্রামের বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল আর তার পরিবারের জন্য একটু জমি। শহরের লোকেরা তার কথা রাখে।

আজও রাখি পাহাড়ে বাঁশি বাজায়। তার সুরে এখন গ্রামের বাচ্চারাও গান গায়। তারা শিখেছে, দারিদ্র্য শরীরকে কাবু করতে পারে, কিন্তু মনের সুরকে কেউ বাঁধতে পারে না।

Comments

    Please login to post comment. Login