দেশের অন্যতম বৃহত্তর ও ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নদী হলো বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার কূল ঘেসেই রাজধানী শহর ঢাকা। একসময় এই নদীই ছিল ঢাকার বাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রধান রুট । তবে কালের পরিক্রমায় বুড়িগঙ্গার সেই সোনালি দিনগুলো এখন আর নেই। এখন দেশের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর একটি হলো এই বুড়িগঙ্গা । এ যেন অলিখিতভাবে ঢাকা শহরের অন্যতম ময়লার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি বুড়িগঙ্গার নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে শ্যামবাজারের পচা সবজি, বাদামতলীর পচা ফল এবং বিভিন্ন হোটেল-দোকানপাটের ময়লা আবর্জনা। সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়ি থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ফেলা হচ্ছে এসব ময়লা। ফলে এসব ময়লা পানির সঙ্গে মিশে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্গন্ধ। প্রতি মুহূর্তে নদীর ভেতর ফেলা হচ্ছে পানি দূষণকারী বর্জ্য।
এছাড়া দেখা যায়, সদরঘাট ও ওয়াইজঘাটসহ কয়েকটি জায়গায় স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে নদীতে আসছে ঢাকা সিটির ময়লা পানি। এতে নদীর পানি আরও কালো ও দুর্গন্ধময় হয়ে উঠছে। ফলে বুড়িগঙ্গার বড় অংশেই জলজ প্রাণী বা মাছের দেখা মিলছে না। এর বিপরীতে দেখা মিলছে খাওয়ার অনুপযোগী সাকার মাছ, যা অন্যান্য মাছের বাস্তুসংস্থান ধ্বংসের জন্য দায়ী। সাকার মাছের জন্য বুড়িগঙ্গা থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অন্য মাছও।
এদিকে দেশের অন্যতম বৃহৎ বুড়িগঙ্গা নদীর উৎসমুখ চুনার থেকে বসিলা হয়ে লালবাগ-লোহারপুল পর্যন্ত আদি বুড়িগঙ্গার পাড় দখল করে নানা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও শিল্প কারখানার মতো বৃহৎ প্রকল্প ও ব্যাপক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এই নদীর জায়গা দখল করে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গড়ে উঠছে স্থাপনা। ফলে কমছে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা। সেই সাথে কমছে পানি প্রবাহও।
পঁচা কালো পানিতে অল্প সময় পরপরই ঢেউ তুলছে লঞ্চ, স্টিমার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। প্রয়োজন ছাড়া কেউই যেন বুড়িগঙ্গার আশপাশে প্রচণ্ড দুর্গন্ধের জন্য ঘেঁষতে চান না । এমনকি প্রচণ্ড দুর্গন্ধের জন্য অনেক যাত্রী জরুরী প্রয়োজনে কোনোমতে মাস্ক লাগিয়ে নদী পাড় হয়ে কেরানীগঞ্জ যায়। অথচ একসময় এই বুড়িগঙ্গার পাড়ই ঢাকাবাসীর কাছে অবকাশ যাপনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও বুড়িগঙ্গাকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে এখনো ব্যতিক্রমী কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে আগের মতোই দূষণ ও দখলকে ধারণ করেই কোনোরকমে টিকে আছে ঢাকার ঐতিহ্য বুড়িগঙ্গা নদী। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর এক সূত্রে জানা যায়, "গত ৮ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা নদীর দখল ও দূষণরোধে আশু ব্যবস্থা নেওয়া, দূষণ ও দখলকারীদের জরিমানা এবং রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকার নৌপথ চালু করাসহ সাত দফা দাবিতে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় সোয়ারিঘাটে মানববন্ধন করে সংগঠনটি। তবে এখন পর্যন্ত বাপার এসব দাবি পূরণে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।"
বুড়িগঙ্গার দখল ও দূষণ বিষয়ে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক অর্থ বিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী মো. শাহরিয়ার সুলতান মনে করেন, "বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ হলো নদীর তীরের শিল্প কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হয়। ফলে রাসায়নিক বর্জ্যের তেজস্ক্রিয়তার কারণে দিন দিন দূষিত হয়ে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি। বুড়িগঙ্গা নষ্ট হওয়ার আরেকটি কারণ এই দখল।"
এছাড়া বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন বুড়িগঙ্গা দখলের জন্য ২৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাকে দায়ী করে। নদীকে রক্ষা করতে হলে এই কর্মকাণ্ডগুলোকে আগে থামাতে হবে। একই সাথে সিটি কর্পোরেশনের কোনো বর্জ্য যেন নিষ্কাশন ছাড়া নদীতে না ফেলা হয় তাও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যারা নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে তাদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বুড়িগঙ্গা নদী আমাদের দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ। এই নদীর সেই পুরনো জৌলুস ফিরিয়ে আনাও আমাদের দায়িত্ব।