Posts

সমালোচনা

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার সংস্কার চাই

April 19, 2025

imt uddin

100
View

বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীরা দিনদিন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টের পর যখন ভারতের সাথে বাংলাদেশের টানাপোড়ন চলছে এবং ভারতে বাংলাদেশিদের যাওয়া যখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে তখন চিকিৎসার জন্য এদেশের মানুষ আরো বেশি করে দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। গ্রাম থেকে শহর—সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

তবে এই খাতের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং নৈতিক মান নিয়ে দীর্ঘদিনের সমস্যা এটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে।
 

নানা অনিয়ম, অতিরিক্ত মুনাফার লোভ, ঘুষ নিয়ে রোগীর সিরিয়ালে অনিয়ম, দালালনির্ভরতা এবং রোগীদের প্রতি অবহেলার মতো ঘটনা প্রায়ই গণমাধ্যমগুলোর সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে।

এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনস্বার্থের সাথে সমন্বয় করতে হবে। সরকারকে এই ব্যাপারে যথাযথ সংস্কার আনতে হলে কিছু যথাযথ ও সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো কঠোর তদারকি এবং বাধ্যতামূলক নিবন্ধনব্যবস্থা চালু করা, যেখানে প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) সতর্ক দৃষ্টির আওতায় দায়িত্ব পালন করবে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক নিয়োগ করা যেতে পারে, যিনি শুধু এই খাতের তদারকির জন্য নিবেদিত থাকবেন। এর পাশাপাশি হয়রানি বন্ধ করতে একটি কেন্দ্রীয় ডিজিটাল রেজিস্ট্রি এবং লাইসেন্সিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।  এছাড়া নিরীক্ষা এবং পরিদর্শনের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

শুধু তদারকিই যথেষ্ট নয়। এর পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামোতে আমূল সংস্কার আনা প্রয়োজন। বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর জন্য একটি ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। এই বোর্ডের নেতৃত্বে থাকবেন একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ। বোর্ডের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য হবেন নিবন্ধিত চিকিৎসক, যাতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে পেশাগত দক্ষতা প্রয়োগ করতে পারেন।

গুণগত মান নিশ্চিতকরণে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রেডিং পদ্ধতির আওতায় আনতে হবে। এই গ্রেড নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মানদণ্ড বিবেচনা করা যেতে পারে। হাসপাতালের ক্ষেত্রে আইসিইউ ব্যবহারের হার, সংক্রমণের মাত্রা, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং রোগীর সন্তুষ্টির মাত্রা ইত্যাদি বিবেচনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর ক্ষেত্রে পরীক্ষার নির্ভুলতা, যন্ত্রপাতির সুরক্ষা এবং রিপোর্টিংয়ের মান বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।

এমন গ্রেডিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো উন্নতির দিকে ধাবিত করবে। এটি রোগীদের জন্যও একটি বড় ধরনের সুবিধা নিয়ে আসবে। কারণ গ্রেডিং পদ্ধতি থাকলে তারা সচেতনভাবে বেছে নিতে পারবেন কোথায় তারা যথাযথ সেবা পাবেন। ফলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সামগ্রিক সেবার মান বাড়বে।

এছাড়া সব প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ‘কন্টিনিউয়িং মেডিকেল এডুকেশন’ (সিএমই) প্রোগ্রাম চালু করা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এই প্রোগ্রামগুলো চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের  আপডেট ধারণা ও জ্ঞান পেতে সহায়তা করবে, তাঁদের দক্ষতা বাড়াবে এবং পেশার প্রতি তাদের সংযুক্তি আরো বাড়াবে।

আর্থিক তদারকি এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিতেও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সেবার মূল্য সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী নির্ধারণ করা উচিৎ যেন স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। হাসপাতালগুলোকে তাদের মোট শয্যার ১০ শতাংশ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে তাদের সেবার ৫ শতাংশ দরিদ্র রোগীদের জন্য বিনামূল্যে প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিৎ।

এর ফলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশের জন্যও স্বাস্থ্যসেবার দরজা খুলে দেবে। এ ছাড়া লাভের অংশীদারত্ব বা রেফারেলভিত্তিক চুক্তিগুলো সরকারের পর্যালোচনা এবং অনুমোদনের আওতায় আনা উচিত। এটি শোষণমূলক চর্চা অনেকাংশে কমাবে এবং জনগণের কল্যাণ হবে।
 

‘ডুয়াল প্র্যাকটিস’–এর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ বছরের মধ্যে পূর্ণকালীন চিকিৎসক জনবল কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ উন্নীত করতে হবে। ফলে হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ার পাশাপাশি চিকিৎসকের বেকারত্ব কমবে।

স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করতেও উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। সাধারণ জনগণের পাশাপাশি তাদের কথাও বিবেচনায় আনতে হবে। চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য কর্মীদের জন্য একটি জাতীয় মানসম্মত বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা যেতে পারে। এটি ন্যায্য মজুরি, আর্থিক স্থিতিশীলতা ও চাকুরির নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। আর্থিক অনিশ্চয়তা কমে গেলে হতাশা বা দারিদ্র‍্যের চাপ থেকে উদ্ভূত অনৈতিক চর্চার প্রবণতাও হ্রাস পাবে।

চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনিশিয়ানের জন্য বাধ্যতামূলক পেশাগত দায়বদ্ধতা বিমা চালু করা যেতে পারে। এর ফলে মেডিকো-লিগ্যাল ক্ষেত্রে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ফলে সেবার মান উন্নত হবে এবং রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

যখন কোনো ভুল হয় তখন রোগীদের তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য ও সহজলভ্য উপায় প্রয়োজন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলকে (বিএমডিসি) একটি ডিজিটাল অভিযোগ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে শক্তিশালী করা যেতে পারে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রোগীরা তাদের অভিযোগ জমা দিতে পারবেন। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্পলাইন (১৬২৬৩) সম্প্রসারণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা যেতে পারে। এটি রোগীদের অভিযোগ ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য একটি সহজ মাধ্যম হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে বিএমডিসিকে আইনি ক্ষমতা প্রদান করা হলে তারা যাচাইকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে দ্রুত ও ন্যায্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

সবশেষে সরকার নৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পারে। বাস্তবায়নের সুবিধার্থে এই বিষয়গুলোকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনা প্রয়োজন। তাই ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ সংশোধন করে একটি যুগোপযোগী ও স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করতে হবে। এই সমন্বিত ব্যবস্থাসমূহ শুধু স্বাস্থ্যসেবার মানকেই উন্নত করবে না বরং বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি জনগণের মধ্যে আস্থা ও নির্ভরতা ফিরিয়ে আনবে।
 

Comments

    Please login to post comment. Login