Posts

প্রবন্ধ

মানসিক চাপ : আধুনিক বিশ্বের  সমস্যা

April 19, 2025

imt uddin

116
View

আধুনিক বিশ্বে "মানসিক চাপ" শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। এই শব্দটার সাথে আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা উৎপ্রোতভাবে জড়িত। আধুনিক উন্নত জীবন সবাইকে এই শব্দের সাথে নেতিবাচকভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। এমনকি একটি ছোট্ট শিশুও মানসিক চাপ থেকে মুক্ত নয়, বয়স্কদের কথা তো বাদই দিলাম।

 "মানসিক চাপ" বলতে মনস্তত্ত্বের উপর কোনো লক্ষ্য চাপিয়ে দেয়ার ফলে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক অস্থিরতা বা উৎকণ্ঠাকে বুঝানো হয়; যার পরিমিত পরিমাণ ভালো কিন্তু পরিমাণের চেয়ে অত্যধিক হলে ব্যক্তির মন ও স্বাস্থ্যের উপর খারাপ পরিণতি ডেকে আনে। উদাহরণস্বরূপ, বরফকে আমি পানিতে রূপান্তর করতে চাচ্ছি। তাহলে এই লক্ষ্য পূরণে আমাকে অবশ্যই বরফের উপর ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে বরফ গলে তরলে রূপান্তর হবে এবং আমার উদ্দেশ্যও সাধিত হবে।  কিন্তু আমি যদি এর চেয়ে বেশি পরিমাণ তাপ দিয়ে ফেলি অর্থাৎ ১১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বরফকে তাপ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করি তবে বরফ পানিতে রূপান্তর হবার পরিবর্তে বাষ্পে রূপান্তর হতে আরম্ভ হবে এবং আমার উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে। শেষ ঘটনায় আমি ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ বাড়তি দিয়ে ফেলেছি যা ছিল পরিমিত বা প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে বেশি। আর পরিমাণের চেয়ে বেশি চাপ বরফ সহ্য করতে পারেনি, তাই তখন পানিতে রূপান্তরের পরিবর্তে বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।

এই উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট বুঝা গেল যে, মানসিক চাপ দুই প্রকার। যথাঃ (১) ইতিবাচক মানসিক চাপ, (২) নেতিবাচক মানসিক চাপ। বরফকে পানিতে রূপান্তর করার উদ্দেশ্য সাধনে আমাকে ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ প্রয়োগ করে যে চাপ দিতে হয়েছে তা ছিল ইতিবাচক তথা পরিমিত মানসিক চাপের উদাহরণ। অর্থাৎ আমার উদ্দেশ্য পূরণে যতটুকু মনের উপর চাপ আমাকে নিতে হবে বা মনকে উদ্দেশ্য পূরণে কাজটি করার জন্য যতটুকু চাপ দিতে হচ্ছে তা হলো ইতিবাচক মানসিক চাপ আর এই ইতিবাচক বা পরিমিত মানসিক চাপ বাস্তব জীবনে প্রত্যেকটি কার্য সাধনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে নিঃসন্দেহে।  তাই মনোবিজ্ঞানের মতে, এরূপ ইতিবাচক মানসিক চাপ ভালো এবং স্বাস্থ্যের উপর তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। বরং এরূপ মানসিক চাপ না থাকলে কেউ গুরুত্বসহকারে কোনো কাজ করতো না, পৃথিবীটা ধীরে ধীরে অচল হয়ে যেতো। 
আর নেতিবাচক মানসিক চাপের উদাহরণ হলো বরফের উপর ১১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করার মতো ঘটনা। এখানে ১০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ প্রয়োগ ইতিবাচক মানসিক চাপের উপমা,  অন্যদিকে বাড়তি অপ্রয়োজনীয়  ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তাপ প্রয়োগ ছিল নেতিবাচক মানসিক চাপের উপমা, যা আসল উদ্দেশ্য সাধনে আমার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হয়ে যাওয়ায় আমার আসল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করেছে। অর্থাৎ আমার উদ্দেশ্য সাধনে মনের উপর যতটুকু কাজের চাপ নিতে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ কাজের চাপ গ্রহণ করলে সেটা হবে অপ্রয়োজনীয় বা নেতিবাচক মানসিক চাপ আর এটা মনের অবস্থা ও স্বাস্থ্যের উপর গভীর ও নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।

এই নেতিবাচক মানসিক চাপ এখন আধুনিক প্রযুক্তি ও অসুস্থ প্রতিযোগিতাপূর্ণ সংস্কৃতির বদৌলতে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সবার মনে কমবেশি দেখা যাচ্ছে। 


এই নেতিবাচক মানসিক চাপের প্রধান কারণ হিসেবে অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে দায়ী করা যেতে পারে। আর আধুনিক প্রযুক্তি এই অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে আরও বৃদ্ধি করতে যেন আগুনের উপর ঘি ঢালার মতোই কাজ করে যাচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সোশাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত চাকচিক্যময় তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে যা আমাদেরকে আরো পাবার লোভ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে কে কার চেয়ে বেশি অর্জন করতে পারবে এই জন্য সবাই মানসিকভাবে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছে। সোশাল মিডিয়ায় সবাই নিজেদেরকে জাহির করার জন্য নিজেদের বিভিন্ন সাফল্যমণ্ডিত ছবি পোস্টে শেয়ার করছে। এগুলো দেখে সবাই ঈর্ষান্বিত হয়ে আরো সাফল্যমণ্ডিত ছবি পোস্টে শেয়ার করার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাব্যবস্থার অত্যধিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ পদ্ধতি কোমলমতী শিক্ষার্থীদেরকে শৈশবের প্রারম্ভ থেকেই অসুস্থ প্রতিযোগিতার সাথে মানসিকভাবে পরিচিত করাচ্ছে। আমরা আগেই বলেছি যে, মানসিক চাপ পরিমিত হলেই ভালো। এর বেশি হলে খারাপ। অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভূত যখন মানুষের মাথায় ভর করে তখন মানুষ তা পাবার জন্য পরিমাণের চেয়ে বেশি মানসিক চাপ নিয়ে ফেলে।
মানসিক চাপের কারণ হিসেবে আমি এক শব্দে "অসুস্থ প্রতিযোগিতা" কে মুখ্য কারণ হিসেবে দায়ী করছি। কারণ ভালোভাবে খতিয়ে দেখলে ঘুরেফিরে মানুষ অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে মানসিক চাপের শিকার হয়ে থাকে। মানসিক চাপের মূলে রয়েছে "অসুস্থ প্রতিযোগিতা" আর এটাকে সহজেই জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বাড়িয়ে দিচ্ছে আধুনিক  তথ্যপ্রযুক্তি। অনেক সময় সরাসরি না হয়ে পরোক্ষভাবেও  "অসুস্থ প্রতিযোগিতা"এর কারণেও মানসিক চাপ বেড়ে যায়।

মানসিক চাপের ফলে প্রথমে মানুষের মনোজগৎ এলোমেলো হচ্ছে ও বিভিন্ন মানসিক রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। 
অতঃপর এক পর্যায়ে তা শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং বিভিন্ন শারীরিক রোগ সৃষ্টি হচ্ছে যেটাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় "মনোদৈহিক রোগ" বলে থাকে। মানসিক চাপ থেকে বের হয়ে আসা আমাদের সুস্থ জীবনযাপন এর জন্য অত্যন্ত জরুরী।


নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে হবে।

(১) "অসুস্থ প্রতিযোগিতা" দূর করুন:

যতক্ষণ না এই "অসুস্থ প্রতিযোগিতা" দূর করা সম্ভব হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মানসিক চাপকে পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হবে না। তাই সবার আগে "অসুস্থ প্রতিযোগিতা" দূর করতে যা করা প্রয়োজন তা করুন।

(i) আগে মানসিক চাপ নেবার সামর্থ্য ও মানসিক চাপের পরিমিত পরিমাণ নির্ধারণ করুন।  অতঃপর নিজের সামর্থ্য বুঝে পরিমিত পরিমাণ মানসিক চাপ গ্রহণ করুন।

(ii) অন্যদের সাফল্যের দিকে তাকানো পুরোপুরি বন্ধ করুন। কারণ এটা করলেই "অসুস্থ প্রতিযোগিতা" এর  সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনে যথাসম্ভব সোশাল মিডিয়ার ব্যবহার কমিয়ে আনুন।
 

(২) ফলাফলের চিন্তা বাদ দিয়ে যথাযথ উপায়ে কাজ করুন:

ফলাফলের চিন্তা মাথায় নিয়ে মানসম্মত কাজ করাটা মুশকিল। ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তা আমাদেরকে অনেক সময় ভালোভাবে কাজ করতে দেয় না। ফলে কাজ করার সময় প্রতি স্তরে স্তরে মানসিক চাপ অনুভব করি আমরা। কাজকে ঠিকমতো উপভোগ করতে পারি না।
ফলে কাজটা ঠিকমতো হয় না। কাজ ঠিকমতো না হলে মানসিক চাপ আরো বাড়ে।

তাই কাজ করার সময় শুধু কাজটাকেই প্রতি স্তরে স্তরে উপভোগ করুন, কাজটিকে সঠিক উপায়ে করার চেষ্টা করুন, প্রয়োজনবোধে কাজের সঠিক উপায় জেনে নিয়ে তারপর কাজে নেমে পড়ুন। যদি কাজটা যথাযথ উপায়ে মনোযোগসহকারে করতে পারেন এবং কাজটাকে উপভোগের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে তাহলে মানসিক চাপ বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

(৩)স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখুন:

একটি প্রচলিত প্রবাদ বাক্য: " স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল"। কথাটা পুরোপুরি সত্য। দেহ অসুস্থ থাকলে মন ভালো থাকে না। দৈহিক অসুস্থতা মানুষকে মানসিক চাপের দিকে নিয়ে যায়। দৈহিক অসুস্থতা আমাদের উপর এক প্রকার চিকিৎসার খরচের বোঝা চাপিয়ে দেয়। এই খরচের বোঝা টানতে গিয়ে আমরা আবার মানসিক চাপে পড়ে যায়। তাই "Prevention is better than cure"কথাটি আমাদেরকে মেনে চলতে হবে। রোগ হবার আগেই সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে।

(i) গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে।
(ii) স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
(iii) শরীরে কোন রোগ আছে কিনা তা চিহ্নিত করে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো রোগকে দেহে বসবাস করতে দেয়া যাবে না। 
(iv) স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যা যা করা দরকার সব করতে হবে। প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলুন।
 

(৪)স্রষ্টার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন:
 

স্রষ্টার সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুললে মানসিক চাপ কমে আসে যা বাস্তবসম্মত। 
(i) পাপ কাজ ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে চেষ্টা করুন।
(ii) নিয়মিত স্রষ্টার নিকট গভীরভাবে প্রার্থনা করুন।
(iii) স্রষ্টা আপনাকে যা কিছু দিয়েছেন তার একটা লিস্ট স্মরণ করুন এবং সেগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ থাকুন।
(iv) ধর্মীয় শিষ্টাচার ও বিধিবিধান মেনে চলুন যথাসাধ্য।
 

(৫) মানসিক চাপ অন্যদের সাথে শেয়ার করুনঃ

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অধিকাংশ চাপা স্বভাবের মানুষেরা মানসিক চাপের সম্মুখীন হয় বেশি। তাই মানসিক চাপ কমাতে তা অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। আপনজনদের সাথে ভাগাভাগি করে নিন। কিন্তু শোভাকাঙ্খী ও সমস্যাটার সমাধান করতে আগ্রহী এমন মানুষদের সাথেই নিজের মানসিক চাপ ভাগাভাগি করে নিবেন, এর বাহিরে অন্য কারোর সাথে নয়।

(৬) সমস্যাকে যেকোনো মূল্যে সমাধান করার চেষ্টা করুনঃ

জীবনে সমস্যা যত বেশি থাকবে, মানসিক চাপও তত বেশি থাকবে। তাই সমস্যাকে দ্রুত সমাধান করে ফেলুন। পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব না হলে সমস্যাটার স্রোত কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন।

(৭) সম্ভব হলে নিজের মন,  রুচি ও মেধার সাথে মিল আছে এমন উপযুক্ত কাউকে বিবাহ করে ফেলুনঃ

মনের মানুষকে বিয়ে করতে পারলে ও মনের মানুষের সাথে নির্জন সময় কাটাতে পারলে মস্তিষ্ক থেকে "Happy Hormone" নিঃসৃত হয় যা মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হয়। তাই মনের সাথে মিল আছে এমন মানুষ খুঁজে দ্রুত বিয়ে করে ফেলুন যদি সম্ভব হয়।

Comments

    Please login to post comment. Login