ঘরের মাঝখানে কাঠের পুরনো চেয়ার। সেই চেয়ারে বসে আছেন হাশেম আলী। চোখ দুটো বন্ধ, নিঃশ্বাস যেন থেমে আছে। ঘরের বাতাস নিস্তব্ধ, এমনকি নিজের হৃদস্পন্দনও যেন শুনতে পারছে না আলিফ।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল, ফিসফিস করে বলল—
"দাদু… আমি এসেছি। ছায়াদের জগত পার হয়ে তোমাকে ফিরিয়ে নিতে।"
হাশেম আলীর চোখ খুলে গেল। কিন্তু তা ছিল শূন্য। গভীর দুই গর্ত, যার ভেতরে নড়ছে একেকটা গল্প… একেকটা ছায়া।
"তুই দেরি করেছিস, লাম… আমি তো এখন আর আমি নই।"
আলিফ কাঁপতে কাঁপতে বলে, "না! তুমি আমার দাদু! তোমার লেখা, তোমার স্মৃতি, সব আমি জানি!"
হাশেম আলী হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। তার পেছনের দেয়ালটা গলে গলে সরে যেতে লাগল। দেখা গেল এক বিশাল মণ্ডপ—কিছু ছায়া বসে আছে সারিতে, দর্শকের মতো। তাদের মুখ নেই, চোখ নেই, কিন্তু হাতে হাততালি। মাঝখানে একটা মঞ্চ, যেখানে লেখা—
"শেষ সত্য: গল্পের বিনিময়ে মুক্তি"
একটা ছায়া এগিয়ে এল। কণ্ঠে একটা প্রাচীন কাঠিন্য,
"তোর দাদু একটা গল্প অসম্পূর্ণ রেখেছিল। আমরা তাকে আটকে রেখেছি যতক্ষণ না সেই গল্পের শেষ লেখা হয়। এখন তুই শেষটা লিখবি। কিন্তু শর্ত আছে—তুই যা লিখবি, তাই সত্যি হবে।"
আলিফ চুপ করে যায়। সে জানে, যদি ভুল কিছু লেখে, ছায়ারা সেই সত্য বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু দাদুকে ছাড়াতে হলে গল্প শেষ করতেই হবে।
সে কাঁপা হাতে দাদুর কলমটা তোলে। লেখে—
"এক বৃদ্ধ কবি, যিনি ছায়াদের বন্দী ছিল, একদিন তার নাতির ভালোবাসা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। ছায়ারা কাঁদে না, কিন্তু সেদিন তারা কেঁদেছিল…"
এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর একটা আলো ফুটে উঠল। হাশেম আলীর চোখজোড়া আবার ভরে উঠল আলোয়। মুখে এক শান্ত হাসি।
তিনি বললেন,
"তুই পেরেছিস, আলিফ। কিন্তু মনে রাখিস… প্রতিটা গল্প শেষ হলেও, ছায়া কখনো হারিয়ে যায় না। তারা অপেক্ষা করে… নতুন লেখকের জন্য…"
দাদুর শরীর হালকা হয়ে গেল, বাতাসে মিলিয়ে গেল একরাশ ধোঁয়ায়।
ছায়ারা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো। কেউ কিছু বলে না। শুধু একটিমাত্র দরজা খুলে গেল। সেখানে লেখা:
"আলোয় ফেরো, গল্পকার। আজকের জন্য ছায়ারা ঘুমোবে।"
---
আলিফ চোখ খুলে দেখে—সে তার নিজের ঘরে, নিজের বিছানায় শুয়ে। হাতে দাদুর সেই কলম। সামনে খোলা ডায়েরি। কিন্তু পেছনে দেয়ালের ছায়া একটু বেশি গাঢ়… একটু বেশি সচেতন।
---
শেষ…?