বাংলাদেশে রাজনীতি করা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাজ নয়। সেটি তাঁর জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য হওয়াও উচিত নয়। রাজনীতির কাদামাটিতে নয়, জ্ঞানের মঞ্চই তাঁর প্রকৃত স্থান
সারা বিশ্বে তাঁর পরিচিতি, চিন্তা ও কর্মধারা—যতটা বিস্তৃত, যতটা প্রভাবশালী, ততটাই অনন্যসাধারণ। বিশ্বজুড়ে তাঁর বক্তৃতা শুনে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে তাঁর মাইক্রোক্রেডিট তত্ত্ব পড়ানো হয়, নানা দেশে তাঁর উন্নয়ন মডেল বাস্তবায়িত হয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের যে ক’জন মানুষ সম্মান কুড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে রাখতেই হয় ড. ইউনূসকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গেও ড. ইউনূসের সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। তাঁরা একাধিক নীতিনির্ধারণী প্রয়াসেও ছিলেন সহযাত্রী। কিন্তু ২০০৭ সালে যখন তিনি ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেন, তখনই বদলে যায় দৃশ্যপট। মুহূর্তেই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন ‘অবাঞ্ছিত’ এক চরিত্রে।
ড. ইউনূস বলেছিলেন, "বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা জনগণের জন্য কাজ করেন না।" এই সরল বাক্যই হয়ে ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের প্ররোচনা। তাঁকে ঘিরে শুরু হয় মামলা, হয়রানি, অপমান ও নিষ্ঠুর বিদ্বেষ। রাজনীতিতে নামার ইচ্ছা নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের চক্রেই তাঁর অধিষ্ঠান এখন রাজনীতির জটিল আঙিনায়।
এই প্রজ্ঞাবান মানুষটি বিশ্বের অন্যতম উচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত বক্তা। Core Speakers Agency, Premiere Speakers Bureau, এবং Celebrity Talent International-এর তথ্য অনুযায়ী, তাঁর বক্তৃতা ফি ৭৫ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ, বিশ্ব তাঁকে শোনে, বুঝতে চায়, গ্রহণ করে।
কিন্তু গত বছর ৮ আগস্ট তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিশ্বমঞ্চে তাঁর কণ্ঠ স্তব্ধ। অর্থনৈতিক দার্শনিক ও মানবিক চিন্তাবিদের সে অনুপস্থিতি শুধু আমাদের নয়, বিশ্বকেও বঞ্চিত করছে এক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানসিক দিকনির্দেশনা থেকে।
বাংলাদেশে কেউ কেউ তাঁকে দার্শনিক রাজা বানিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তাঁরা আদতে প্রজ্ঞার অনুরাগী নন, তারা কৌশলী রাজনীতিক। অথচ ড. ইউনূস রাজনীতির লোক নন—তাঁর জায়গা রাজনীতির ক্ষমতার বলয়ে নয়, বরং চিন্তার মুক্ত ব্যাকরণে, জ্ঞানের উন্মুক্ত আলোচনায়।
প্রশ্ন উঠতেই পারে—তবে দেশ শাসন করবে কে? উত্তরটা জটিল।এই গুরুচণ্ডালি দেশে সত্যিকারের সুশাসনের আশা করা দুরাশা। কিন্তু তাই বলে যাঁর মূল পরিচয় একজন মেধাবী চিন্তাবিদ, তাঁকে রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি করা যায় না। তাঁকে শ্রোতার আসরে ফিরিয়ে আনতে হবে, বক্তৃতার মঞ্চে ডাকতে হবে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে ‘লাইভ ক্লাস’ নিতে দিতে হবে।
কারণ আমরা এক নিখাদ প্রফেসরের ক্লাস মিস করছি। কেবল আমরা নয়, পুরো বিশ্বের বিদ্বৎসমাজও নিশ্চয়ই তা-ই করছে।
দেশের মানুষকে পাঠ দিতে যদি তাঁকে অন্তত পাড়ার ইশকুলেও ফিরিয়ে আনা যায়, আমরা এক হাজারবার আপনাদের পাশে থাকব। কিন্তু যদি তাঁকে নিয়ে কেবল অন্ধকার রাজনীতি হয়, তাতে আমাদের কোনো মত নেই।
দেশে যদি কোনোদিন আলো নামে, তখন না হয় গুণীদের উপযুক্ত আসন দিন। এখন নয়।
লেখক: সাংবাদিক
১৯ এপ্রিল ২০২৫