এরপর কাজী সাহেব নিজের জায়গা নিলেন। ঘরে যেন হঠাৎ এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
"বিয়ের কাজ শুরু করা যাক,"— কাজীর কণ্ঠে ভরাট গম্ভীরতা।
তখন তৃষার বাবা একটু থেমে বললেন,
"দেন মোহরের পরিমাণ লিখতে হবে..."
সবার দৃষ্টি তখন আমানের দিকে।
কোনো দ্বিধা ছাড়াই আমান বললো,
"দেন মোহর এক কোটি টাকা লিখবেন।"
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘরে যেন একটা চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লো।
"এক কোটি?"— কেউ ফিসফিস করে বললো।
"সত্যি?"
"এতটা বড় অঙ্ক?"
"এমনটা তো কল্পনাও করা যায় না..."
কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমানের দিকে,
আবার কেউ তৃষার ভাগ্যকে ঈর্ষা করলো মনে মনে।
তৃষার বাবা-মাও বিস্মিত হলেও কিছু বললেন না।
আর তৃষা?
সে নিচু চোখে বসে আছে, কিছু না বলে—
মনে হয় না যেন তার এই মোহরের অঙ্কে কিছু এসে যায়।
তবুও, আমান তার মতো করেই বুঝিয়ে দিলো—
তৃষার মর্যাদা তার কাছে কতটা মূল্যবান।
এরপর ঘরে হালকা হাসি, চাপা কানাকানি—সেইসব লোকেরাই যারা কিছুক্ষণ আগেও ছিঃ ছিঃ করছিল, এখন তাদের মুখেই যেন বদলে গেছে সুর।
"মেয়ে টা তো অনেক ভাগ্যবতী, তাই না?"
"হ্যাঁ গো! কপাল বলে একটা কথা আছে, একেবারে রাজকন্যার মতো বিয়ে হলো!"
"আর ছেলেটাও দেখেছো? কত ভদ্র, কত সংযত, এক কথায় রাজপুত্র!"
একজন তো বলেই ফেললো,
"ভাগ্যশালী মেয়ে টা… এমন ছেলের ঘরে বিয়ে হচ্ছে! সে তো অনেক ভালো!"
তৃষা কিছু শুনছে, কিছু শুনছে না।
তার ভেতরে তখনো একরাশ অস্থিরতা, এক অজানা বেদনা আর অদ্ভুত শান্তি।
আর আমান?
সে দূর থেকে তাকিয়ে আছে তৃষার দিকে—চোখে একরাশ সম্মান, স্নেহ আর এক কঠিন প্রতিজ্ঞা।
কাজী এবার চুপচাপ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"আপনি কি এই বিয়েতে সম্মত?"
আমান এক পলক তৃষার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো,
"জি, কবুল।"
ঘর জুড়ে তখন নিস্তব্ধতা।
তারপর কাজী তৃষার দিকে ফিরলেন।
তৃষার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, চোখ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো।
সবার সামনে তৃষা বসে আছে, কিন্তু যেন আত্মা হারিয়ে গেছে কোথাও।
কোনো অভিমান নেই, কোনো প্রত্যাশাও নেই—শুধু একেবারে নিস্তেজ, অনুভূতিহীন চোখে তাকিয়ে আছে সামনে।
কাজী আবার বললেন,
"তৃষা , আপনি কি এই বিয়েতে সম্মত?"
এক মুহূর্তের থেমে থাকা শ্বাসের মতো নীরবতা…
তৃষা একবার চোখ বন্ধ করলো, তারপর আস্তে করে বললো,
"কবুল।"
তিনবার একইভাবে…
"কবুল… কবুল…"
হয়তো এই শব্দ তিনটি চিরকাল তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে,
কিন্তু সেই মুহূর্তে তৃষার হৃদয়ে শুধু একটাই শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল—"আরিয়ান…"
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই চারপাশে যেন এক নতুন আবহ তৈরি হলো।
কাজী সাহেব দোয়া পড়ে উঠলেন, সবাই ‘আমিন’ বললো।
তৃষা আর আমান এখন অফিসিয়ালি একে অপরের জীবনসঙ্গী।
অতিথিদের মুখে তখন হাসি, খাওয়া-দাওয়া চলছে।
শুভাকাঙ্ক্ষীরা এসে একে একে নবদম্পতিকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
কেউ বলছে—
"মেয়ে তো রাজকন্যা, আর বর রাজপুত্র!"
"কি দারুণ একটা জুটি!"
তৃষা ঠোঁটে এক চিলতে হাসি রাখলেও চোখের গভীরতা যেন বলে দিচ্ছে—এই হাসির পেছনে চাপা পড়ে আছে হাজারটা প্রশ্ন।
অন্যদিকে আমান শান্ত, ধীর, কিন্তু চোখে একরকম কঠিন প্রতিজ্ঞার ছায়া।
এক চাচী এসে ফিসফিস করে বললো,
"দেনমোহর শুনলাম এক কোটি টাকা! মাশা’আল্লাহ! মেয়েটা তো আসলেই খুব ভাগ্যবতী!"
তাদের কথায় এখন আর কেউ কুৎসা করে না, বরং সবাই প্রশংসা করছে।
চলবে......