(সম্পূর্ণ গল্প কল্পনা)
অধ্যায় ১: অজানার ডাক
ঢাকার গ্রীষ্মকালীন এক ক্লান্তিকর সন্ধ্যায়, রাহুল জানালার পাশে বসে বাইরের ঘোলাটে আকাশ দেখছিল। বিশাল শহরের কোলাহলের মধ্যে থেকেও তার ভেতরে একটা গভীর নিস্তব্ধতা বাসা বেঁধেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় হিমশিম খাওয়া এই তরুণ ছেলেটা অনেক দিন ধরেই অনুভব করছিল—তার জীবনে কিছু একটা অভাব রয়েছে। এমন কিছু, যা সে বুঝে উঠতে পারে না, শুধু টের পায়।
ঠিক সেই সময়েই হোস্টেলের নিচের রিসেপশনে একটা অদ্ভুত খাম এসে পৌঁছায়। রাহুলের নাম লেখা, কিন্তু কোনো প্রেরকের নাম নেই। কৌতূহলী হয়ে খাম খুলে সে যা পেল, তাতে বুকের ভেতর যেন হঠাৎ ঢেউ খেলে গেল।
ভেতরে ছিল—
১. একটা পুরনো কাগজের মানচিত্র, হাতে আঁকা।
২. একটা ছোট্ট নোট:
“যদি সাহস থাকে, তাহলে রেইনরা দ্বীপে এসো। উত্তর পাবে।
সময়: ১৪ই এপ্রিল
স্থান: চট্টগ্রাম বন্দরের ৭ নম্বর জেটি।”
রাহুলের হাত কেঁপে উঠল। রেইনরা দ্বীপ? জীবনে এই নাম সে আগে কখনো শোনেনি। গুগলে খুঁজে কোনো ফলাফল পেল না। অথচ মানচিত্রে দ্বীপটা অনেকটা স্পষ্ট করে আঁকা। যতই ভাবছিল, ততই একটা অলৌকিক অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল।
তার ভেতরে দুটো রাহুলের যুদ্ধ শুরু হলো। এক পক্ষ বলছে—“তুমি পাগল হয়ে গেছো, এটা একটা ধোঁকা হতে পারে।” অন্য পক্ষ কানে কানে বলছে—“জীবন একঘেয়ে হয়ে গেছে, যদি এটাই হয় সেই রোমাঞ্চের শুরু?”
শেষ পর্যন্ত, দ্বিতীয় পক্ষ জিতে গেল।
অধ্যায় ২: চট্টগ্রামের পথে
১৩ই এপ্রিল ভোর ৫টা। রাহুল তার ব্যাকপ্যাকে কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস ভরে ঢাকার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাল। কাউকে কিছু না বলে, ফোনে শুধু একটি মেসেজ মা’কে করল—“একটা ছোট ভ্রমণে যাচ্ছি, দুশ্চিন্তা কোরো না।”
বাস ছাড়ল। রাহুল জানালার পাশে বসে মনোযোগ দিল মানচিত্রটার দিকে। দ্বীপটা মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে, কিন্তু কোথাও নাম নেই। শুধু আঁকা আছে কিছু চিহ্ন—একটা ঝর্ণা, একটা লাল গোল চিহ্ন, আর রহস্যময় একটা চোখের প্রতীক।
চট্টগ্রাম পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা নামল। রাহুল ৭ নম্বর জেটির পাশে যখন পৌঁছাল, তখন চারপাশে ঘন কুয়াশা। অদ্ভুতভাবে অস্বাভাবিক ঠান্ডা অনুভব হচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই জানে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
হঠাৎ সে দেখতে পেল, একটি ছোট্ট নৌকা, যার মাঝি ছিল এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধটি রাহুলকে দেখেই বলল, “তুমি এসেছো... মানচিত্রের ডাকে সাড়া দিতে?”
রাহুল চমকে উঠল—সে কি আগে থেকেই জানে?
“তুমি কে?” রাহুল জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধ হেসে বলল, “আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। চল, রাত শেষ হবার আগেই দ্বীপে পৌঁছাতে হবে।”
নৌকাটা ধীরে ধীরে অন্ধকার জলে ভেসে চলল। চারপাশে কুয়াশার ঘন পর্দা। রাহুলের হৃদয় বুনছে অসংখ্য প্রশ্ন—এই দ্বীপ কি সত্যি? ওখানে কী আছে? আর কে পাঠিয়েছে এই খাম?
কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—সে কি জীবনে কোনো অজানার উত্তর খুঁজে পেতে যাচ্ছে?
অধ্যায় ৩: রেইনরার উপকূলে
রাহুল নৌকার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে ছিল ভয়ের চেয়ে বেশি বিস্ময়ের ছাপ। চারপাশের কুয়াশা ঘন থেকে ঘনتر হয়ে উঠছিল, আর সমুদ্র যেন নিঃশব্দ এক সুরে গাইছিল এক অজানা গান।
“তুমি কি ভয় পাচ্ছো?” বৃদ্ধ মাঝি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
রাহুল মাথা নাড়ল, “আমি জানি না কী আছে সামনে। শুধু একটা অদ্ভুত টান টের পাচ্ছি।”
বৃদ্ধ হালকা হেসে বলল, “তাহলে তুমি ঠিক পথেই চলেছো। রেইনরা শুধু সাহসীদেরই ডাকে।”
নৌকা যখন কুয়াশা ভেদ করে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, তখন হঠাৎ চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। যেন অন্ধকারের মধ্যে কোনো আলো জ্বলে উঠেছে। রাহুল চমকে তাকাল—দূরে একটা দ্বীপ! তীরঘেঁষে গাছপালায় ঘেরা এক অপার সৌন্দর্য, যেন পৃথিবীর বাইরে কোনো ভুবন। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের মাঝেও লুকিয়ে ছিল এক অপূর্ব গম্ভীরতা।
নৌকা উপকূলে পৌঁছাল। রাহুল পা রাখতেই অনুভব করল, ভূমিটা যেন শ্বাস নিচ্ছে। হালকা একটা কম্পন, যেন দ্বীপটি জীবন্ত।
“তুমি এখানেই নেমে যাও,” বৃদ্ধ বলল। “এই পথ ধরে এগিয়ে চলো। চোখ খুলে রেখো, কারণ এখানে সবকিছুই সত্য, আবার সবকিছুই মায়া।”
“তুমি আসবে না?”
“আমার কাজ এখানেই শেষ। দ্বীপের পথ তুমি একাই খুঁজে পাবে।”
রাহুল নৌকা থেকে নামতেই শুনতে পেল গাছের পাতার মধ্যে ফিসফিসে শব্দ। বাতাসে ভাসছে এক অজানা ঘ্রাণ—না ফুলের, না লবণাক্ত জলের, বরং এমন কিছু যা আগে কখনো শোঁকা হয়নি।
পথে পা রাখতেই চারপাশের জঙ্গল যেন সাড়া দিল। পাতার ফাঁকে চোখে পড়ল কিছু সোনালি আলো, যেন চোখ! রাহুল ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। তার হাতে ছিল শুধু মানচিত্র। প্রথম গন্তব্য—“ঝর্ণার পথ।”
প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর, সে পৌঁছাল এক অসম্ভব সুন্দর ঝর্ণার কাছে। পানি নিচে পড়ছে ক্রিস্টালের মতো শব্দ করে। কিন্তু সেখানে কিছু অস্বাভাবিক।
ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী।
চুল লম্বা, চোখে একধরনের অপার্থিব দীপ্তি।
“তুমি রাহুল?” নারী জিজ্ঞেস করল।
রাহুল অবাক হয়ে বলল, “তুমি কে? কীভাবে আমার নাম জানো?”
নারী মৃদু হেসে বলল, “আমি রেইনা। রেইনরা দ্বীপের রক্ষিকা। তোমার মতো একজনকে আমরা বহু বছর ধরে খুঁজছিলাম। তুমি সেই চিহ্নধারী।”
“চিহ্নধারী? কী চিহ্ন?”
রেইনা এগিয়ে এসে রাহুলের ডান হাত ধরল, আর তার তালুর মাঝে এক মুহূর্তে উদ্ভাসিত হলো সেই মানচিত্রে থাকা চোখের চিহ্নটা।
“এটা...” রাহুল স্তব্ধ।
“এই চিহ্নই তোমাকে ডেকেছে,” রেইনা বলল। “এখন শুরু হবে তোমার সত্যিকারের যাত্রা—স্মৃতির গভীর রাজ্যে।”
রাহুলের সামনে এখন এক অদ্ভুত সত্য। দ্বীপ শুধু একটি জায়গা নয়, এটা তার নিজেরই এক প্রতিচ্ছবি, তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের মিলনস্থল।
অধ্যায় ৪: স্মৃতির বাগান
রেইনার হাত ধরে রাহুল যখন ঝর্ণার পাশ দিয়ে গহীন বনের ভেতর ঢুকল, তখনই সে টের পেল—এই পথ বাস্তবের নয়। প্রতিটি গাছ যেন একেকটা চিত্রকল্প, পাতায় পাতায় ভাসছে পুরনো স্মৃতি, অজানা কাহিনি। বাতাসে এক ধরণের ঘোর লাগা সুবাস, যা তার মনে এনে দিচ্ছে শৈশবের ঘ্রাণ, মায়ের কণ্ঠস্বর, প্রথম ভালোবাসার হাসি।
“এখানে আমরা পৌঁছেছি,” রেইনা বলল। “এটাই স্মৃতির বাগান।”
রাহুল তাকিয়ে দেখল—এক বিশাল খোলা মাঠ, ঘাসে ঢাকা, কিন্তু প্রতিটি ঘাস যেন কাঁচের তৈরি। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত কিছু গাছ, যাদের পাতাগুলো আয়নার মতো চকচকে। গাছের গায়ে লেখা অস্পষ্ট কিছু নাম—সবগুলোই মানুষের নাম, এবং প্রত্যেকটির নিচে একটি করে ক্ষুদ্র স্মৃতিচিত্র ভাসছে, যেন কোনো দৃশ্যপট।
রাহুল হাঁটতে হাঁটতে একটি গাছের সামনে থামল। নামটি দেখে তার শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি উঠল—“রাহুল সেন”।
“এটা… আমার নাম?” তার কণ্ঠে বিস্ময়।
“হ্যাঁ,” রেইনা বলল। “প্রত্যেক মানুষ এখানে একবার আসে। এই দ্বীপ কেবল তাদেরই ডাকে, যাদের জীবনে কোনো উত্তর অপূর্ণ থাকে। এই গাছ তোমার জীবন—তোমার স্মৃতি, ভুল, ভুলে যাওয়া সত্য।”
রাহুল গাছের গায়ে হাত রাখতেই মুহূর্তেই চারপাশ বদলে গেল। সে দেখতে লাগল এক একটি দৃশ্য—তার শৈশব, যখন সে স্কুলের প্রথম দিন কেঁদে ফেলেছিল, কলেজ জীবনের প্রথম প্রেম, বাবার চিঠি পড়ে অঝোরে কাঁদা, আর এমন সব মুহূর্ত যা সে ভুলে গিয়েছিল।
তার গলা ধরে এলো। “এটা কি সত্যি? আমি এগুলো ভুলে গিয়েছিলাম...”
“স্মৃতি কখনো হারায় না,” রেইনা বলল। “এই দ্বীপ সেইসব স্মৃতির পাহারাদার। কিন্তু তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে—তোমার জীবনের এক বিস্মৃত অধ্যায় আছে, যেটা তুমি কখনোই জানোনি। সেটা জানতে হলে তোমাকে যেতে হবে 'অন্ধকার গুহায়'।”
“গুহা?” রাহুল জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ,” রেইনা বলল। “সেখানে আছে তোমার অতীতের এক রহস্য—তোমার জন্মের আগের সত্য। সেটাই তোমার যাত্রার চূড়ান্ত ধাপ।”
রাহুল কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলল, “আমি প্রস্তুত... কিন্তু তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?”
রেইনা মাথা নাড়ল, “না রাহুল। এই পথ তোমাকেই একা যেতে হবে। ভয় পেয়ো না, কারণ যত গভীরে যাবে, ততই তুমি নিজেকে চিনবে।”
রাহুল আবার মানচিত্র খুলল। এবার তার চোখে পড়ল গুহার পাশে আঁকা সেই রহস্যময় চিহ্ন—একটা খোলা চোখ, যার ভেতরে একটি চাবি। চাবি, যা খুলে দিতে পারে এক বিস্মৃত স্মৃতি, বা হয়তো একটা গোপন সত্য।
রাহুল পেছনে একবার তাকাল। রেইনা আর সেখানে নেই। শুধু বাতাসে ভাসছে তার কণ্ঠস্বর—
“সত্য কখনো সহজ হয় না, কিন্তু তা-ই একমাত্র মুক্তি।”
অধ্যায় ৫: অন্ধকার গুহা
রাহুলের পা চেপে বসলো ভেজা মাটির ওপর। তার সামনে এখন অন্ধকারে ডুবে থাকা একটি গুহা। গুহার মুখে কালো পাথরে খোদাই করা চোখের প্রতীকটা ঝলমল করছে হালকা সোনালি আলোয়।
প্রথমে দ্বিধা হলেও সে সাহস করে ভেতরে ঢুকল। গুহার ভেতর একেকটা ধাপে যেন সময় থেমে যাচ্ছে। দেয়ালে অদ্ভুত চিত্রকলা—যেখানে দেখা যাচ্ছে এক দম্পতি, তাদের কোলে একটি শিশু। ছবির নিচে লেখা—“চিহ্নধারীর জন্ম”।
রাহুল চমকে উঠল। ছবির শিশুটি তার মতোই দেখতে!
পেছন থেকে হঠাৎ এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “তুমি এখন জানতে চলেছো সত্য, যা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল তোমার ভালোবাসার জন্য।”
আলো ফুঁসে উঠল। সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ, চোখে গভীর রহস্য।
“তুমি কে?” রাহুল জিজ্ঞেস করল।
“আমি তোমার দাদা। একসময় এই দ্বীপের রক্ষক ছিলাম। তোমার বাবা-মা এই দ্বীপেই থাকতেন। কিন্তু যখন দ্বীপে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তোমাকে তারা আমাদের জগতে পাঠিয়ে দেন।”
“তাহলে আমি… এই দ্বীপের সন্তান?”
“হ্যাঁ,” বৃদ্ধ বললেন। “তোমার মধ্যে রয়েছে সেই শক্তি, যা দ্বীপকে আবার জাগিয়ে তুলতে পারে।”
রাহুল তখন বুঝতে পারল—তার স্মৃতিচিহ্ন, তার জন্ম, তার আকর্ষণ এই দ্বীপের প্রতি—সবই পূর্বনির্ধারিত।
গুহার ভেতর হঠাৎ এক কম্পন শুরু হলো।
“তুমি সিদ্ধান্ত নাও,” বৃদ্ধ বললেন, “তুমি কি ফিরে যাবে আগের জীবনে? নাকি এখানেই থেকে যাবে এবং তোমার পূর্বপুরুষদের দায়িত্ব নেবে?”
রাহুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমি জানি না আমার ভবিষ্যৎ কেমন, কিন্তু আমি পালাতে চাই না। আমি থাকবো।”
গুহা হঠাৎ আলোয় ভরে উঠল। রাহুলের শরীর থেকে বেরিয়ে এলো এক সোনালি আভা। সে এখন চিহ্নধারী—নতুন রক্ষক।
অধ্যায় ৬: পুনর্জাগরণ
রেইনরা দ্বীপ ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেল। গাছেরা আবার কথা বলছে, বাতাসে ফিরেছে সেই পুরোনো সুর। দ্বীপবাসীরা ফিরে এসেছে নিজেদের আশ্রয়ে।
রেইনা আবার দেখা দিলো।
“তুমি তৈরি,” সে বলল। “তুমি এখন আমাদের রক্ষক। রেইনরার সত্যিকারের উত্তরসূরি।”
রাহুল দাঁড়িয়ে রইল দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে, চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ, ঝর্ণা, আলো। তার জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর সে পেয়ে গেছে।
এক সময় যে ছেলেটি খাম পেয়ে শুধু কৌতূহলে রওনা হয়েছিল, সে আজ এক দ্বীপের আত্মা হয়ে উঠেছে।
বছর পাঁচেক পর।
ঢাকার এক ল্যাবরেটরিতে এক তরুণ গবেষক নতুন এক দ্বীপ নিয়ে গবেষণা করছে—নাম নেই, মানচিত্রে নেই, কিন্তু উপগ্রহে মাঝে মাঝে ধরা পড়ে।
একদিন তার ডেস্কে এসে পড়ে একটি খাম।
ভেতরে লেখা—
“রেইনরা তোমাকে ডাকছে...”
চলবে