হলরুমটা তখন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। অতিথিদের বেশিরভাগই খেয়ে চলে গেছেন। চারদিকে হালকা হালকা আলো, ঘড়ির কাঁটা পার করেছে রাত ২ টা। তৃষা আর আমান চুপচাপ বসে আছে—তৃষার চোখে এখনও চাপা জল, আর আমান যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে।
ঠিক তখনই দরজার পাশে শোরগোল—
আরিয়ান...!
সবাই অবাক।
চোখ বড় বড় করে তাকালো।
হাঁপাচ্ছেন, মনে হচ্ছে দৌড়ে এসেছেন। চারপাশের পরিবেশ হঠাৎ করে থেমে গেলো। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু ভারী নিঃশ্বাস ফেলে আরিয়ান সামনে এগিয়ে এলো।
আরিয়ানের বাবা হতবাক, মায়ের চোখে পানি, আর তৃষা—একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আরিয়ান হঠাৎ বললো—
"বিয়ে হয়ে গেছে?"
তার গলা কাঁপছে, চোখে অসহায়তা।
তৃষা কোনো উত্তর দিল না।
আমান শান্ত গলায় বললো,
"তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছো, মিস্টার আরিয়ান।"
পরিবেশটা হঠাৎ হিমশীতল হয়ে গেলো। আরিয়ান তাকিয়ে রইলো তৃষার দিকে—শুধু তাকিয়ে।
তৃষার চোখে এবার এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
আরিয়ান ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে আছে, সবার চোখ তার দিকে। সে এক ঝলক তাকালো তৃষার দিকে।
তৃষা তখন সবার মাঝে বসে,হাতে মেহেদি, গায়ে লাল শাড়ি। কিন্তু তার মুখ—সেখানে কোনো অনুভূতি নেই। সে যেন সেখানে আছে শুধু উপস্থিত থাকার জন্য, হৃদয়টা যেন বহু আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে।
আরিয়ান একটু এগিয়ে এসে ডেকে উঠলো,
"তৃষা…"
তৃষা ধীরে মাথা ঘোরালো। কিন্তু চোখে কোনো আলোর ঝলক নেই, কোনো ঘৃণা নেই, ভালোবাসা তো দূরের কথা—ছিল কেবল এক শূন্যতা।
"তুমি… আমাকে চিনছো না?" — আরিয়ানের গলা ভারী হয়ে আসে।
তৃষা খুব ঠান্ডা গলায় বলে,
"আমার পরিচিত কেউ যদি কোনো অনুষ্ঠানে না আসে, তাকে কি মনে রাখা উচিত?"
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা।
আরিয়ান হতবাক, কিছু বলতে চাইলো কিন্তু শব্দ গলা দিয়ে বেরোলো না।
আমান একটু সামনে এগিয়ে এসে তৃষার পাশে দাঁড়াল।
আর তখন তৃষা বলল,
"এই মানুষটিই এখন আমার স্বামী। তাকে ছোট করতে চাই না আমি। আর তোমাকে নিয়ে মনে রাখার মতো কিছুই নেই আরিয়ান। ধন্যবাদ—অনেক দেরিতে এলেও এসেছো, বুঝতে পেরেছি… ঠিক করেছিলে ফিরে আসবে, কিন্তু খুব দেরি করে ফেলেছো।"
আরিয়ান এবার কাঁপতে থাকে।
ঘরের পরিবেশটা তখনো ভারী। সবাই চুপচাপ। তৃষা আর কিছু বলছে না। আমান একবার তৃষার দিকে তাকিয়ে বুঝে নিচ্ছে—এই মেয়েটা অনেক কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছে, কিন্তু আজ আর সেই কষ্ট প্রকাশ করতে দিচ্ছে না নিজেকে।
ঠিক তখনই আমান এর দাদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—
“আমি এখন আমার বউকে নিয়ে যেতে চাই। এই বাসর আজ রাতেই বসবে।”
সবাই হঠাৎ চমকে গেলো।
আর তখন, হঠাৎ করে আরিয়ান গলা চড়িয়ে উঠে বললো—
“একটু দাঁড়ান! একটু শোনেন… আমার সাথে কি হয়েছে জানেন আপনারা? আমি ইচ্ছে করে আসিনি না!”
তার চোখে পানি, কণ্ঠে কাঁপুনি। সে একদম আমানের সামনে চলে আসে।
“স্যার আপনি তো আমাকে একটু সময় দিতে পারতেনা! আমি মরিনি! আমার সাথে একটা বড় দুর্ঘটনা… আমি… আমি…”
কিন্তু কেউ কোনো কথা বললো না।
আমানের দাদি মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“তোমার সময় শেষ হয়ে গেছে বাবা। এখন কথা বলার প্রয়োজন নেই।”
আরিয়ান হাতজোড় করে বললো—
“তৃষা… একবার, একবার শুধু আমার চোখের দিকে তাকাও… বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু চাইনি…”
কিন্তু তৃষা তখন আমানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বললো—
“আমার স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কথা বলা কি তোমার সাজে আরিয়ান?”
আর সবাই থমকে যায়।
চলবে.....