‘ব্রতকথা’—একটি শক্তিশালী দর্শনের মুখোমুখি
এস. এম. শুআইব ত্বাসীন

চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের শর্টফিল্ম ‘ব্রতকথা’ বেশ কিছুদিন আগেই দেখেছিলাম। আজ এ নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে হলো, তাই লিখছি। আমি ঠিক সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা বলব না, বরং বলব এক ফিলোসোফিক্যাল শকের কথা। ‘ব্রতকথা’ আমার জন্য ছিল এক ফিলোসোফিক্যাল শক! এটা এমন এক গল্প, যেটা আমার অনেক পুরনো বিশ্বাসগুলোকে সেন্ট্রালাইজ করে আয়নার সামনে দাঁড় করায়—যেখানে প্রেম এবং যৌনতা দুটি ভিন্ন জগত।
আমি সবসময়ই মনে করি, প্রেম আর সেক্স এক নয়। একটা মনের অভ্যন্তরের দরকার, আরেকটা নিতান্তই বেসিক নিড। সমাজ এই দুইটাকে গুলিয়ে ফেলে, আর তার ওপর চাপিয়ে দেয় বিয়ের মতো প্রথাগত এক ট্যাবু। হ্যাঁ, আমার কাছে বিয়েকে স্রেফ একটি প্রথাগত ট্যাবুই মনে হয়। অনেকেই বলে থাকেন যে বিয়ের মাধ্যমে প্রেম পূর্ণতা পায়, তবে আমার কাছে মনে হয় এই কনসেপ্টটি সম্পূর্ণ ভুল। ররং প্রেম-বিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। যাহোক, এই আলাপ আরেকদিন দেয়া যাবে। আজ ব্রতকথাতেই থাকি।
আমার কাছে 'ব্রতকথা' নিছক একটি গল্প নয়—এটি একটি তীক্ষ্ণ দার্শনিক অনুসন্ধান, যা দর্শককে সমাজের গূঢ় প্রথা, নারীর ভূমিকা এবং আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে অনুরণিত করে তোলে। এর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তার সূক্ষ্ম রূপকে এবং সূক্ষ্ম ভাষ্য-প্রয়োগে।
চন্দ্রিলের চিত্রনাট্য একটি প্রশ্নবোধক আয়নায় দর্শককে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়—আমরা যা করছি, তা কি আসলেই আমাদের ইচ্ছা থেকে, নাকি যুগ-যুগান্তরের সংস্কার ও চাপে তৈরি এক অবচেতন প্রোগ্রামিং?
শর্টফিল্মটির দার্শনিক প্রেক্ষাপট মূলত "অস্তিত্ববাদ" (Existentialism) এবং "স্বাধীন ইচ্ছার দ্বন্দ্ব" (Free Will vs. Social Conditioning) ঘিরে আবর্তিত। পরিচালক অত্যন্ত কৌশলে দর্শককে আধ্যাত্মিক আত্মজিজ্ঞাসার দিকে ঠেলে দেন, কিন্তু কোনও পক্ষ চাপিয়ে দেন না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, উত্তর নয়।
সবচেয়ে দারুণ লেগেছে, চন্দ্রিল কখনও জোর করে কিছু বোঝাতে চায়নি। বরং এমনভাবে গল্প বলেছেন, যে আমি নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারি। আমার মতাদর্শ, আমার দৃষ্টিভঙ্গি—সব মিলে যেন একটা ব্যক্তিগত সংলাপ হয়ে গেল এই ফিল্মটার সঙ্গে।
অভিনয়ের কথা বললে, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় ছিল দৃঢ় এবং প্রাঞ্জল। তার চরিত্রটিতে ফুটে উঠেছে জীবনের এক দ্বিধাগ্রস্ত মোড়ে দাঁড়ানো প্রতিটি নারীর প্রতিচ্ছবি—যেখানে ব্যক্তিসত্ত্বার আকাঙ্ক্ষা আর সামাজিক "ব্রত" পালনের দায়বদ্ধতা একে অপরের সঙ্গে লড়ে চলে। চৈতী মিত্র এবং অন্য অভিনেতারাও নিখুঁতভাবে এই দার্শনিক টানাপোড়েনকে সামনে তুলে ধরেছেন।
শেষ কথা? ব্রতকথা আমার বিশ্বাসকে শুধু প্রতিফলিতই করেনি, সেটা আরও গাঢ় করেছে। যারা ভাবেন, জীবন মানে নিজের মতো করে বাঁচা—তাদের জন্য নিঃসন্দেহে এটা একটা নীরব, কিন্তু গভীর আলোড়ন!
--- ০৫ এপ্রিল, ২০২৫