সাত বছর পরে গ্রামের পথে পা রাখল আদিব। শহরের চাকচিক্য আর ব্যস্ততা পেরিয়ে সে এখন ‘চর শালিকপুর’-এর কাঁচা রাস্তায় হাঁটছে। চারদিকে বর্ষার ছাপ—মাঠঘাটে পানি, গাছে গাছে সবুজের হুল্লোড়, মাঝে মাঝে কাঁচা রাস্তা ধুয়ে দিচ্ছে হালকা বৃষ্টি।
এই গ্রামে সে বড় হয়েছে, কিন্তু জীবনের দৌড়ে হারিয়ে ফেলেছিল অনেক কিছু—তাদের মাটির বাড়ি, তালগাছের পাশে বসে বিকেল কাটানো, আর...
আর ‘নীলা’। নামটা এখনও মনে পড়লে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে।
নীলা ছিল ওর প্রতিবেশী, ওদের খেলার সাথী, আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে হয়ে উঠেছিল হৃদয়ের গভীরতম ভালোবাসা।
বর্ষা এলে দুজনই দলা পাকানো কাদা নিয়ে খেলত, পুকুরে ঝাঁপ দিত, ভেজা মাঠে দৌড়াত। নীলার হাসি ছিল বর্ষার মতোই — অচেনা, অবাধ, অথচ শান্তি ছড়িয়ে দেওয়া।
এক বর্ষার দিনেই নীলা ওর হাতে তুলে দিয়েছিল একখানা খাম।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“তুই যদি একদিন চলে যাস, আমি তোর জন্য বর্ষায় অপেক্ষা করব। তুই ফিরবি, আমি জানি। কারণ আমাদের গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।”
কিন্তু গল্পটা থেমে গিয়েছিল হঠাৎ। আদিবের বাবা সরকারি চাকরি পেয়ে শহরে চলে যান, যোগাযোগের সব পথ যেন বৃষ্টির জলে ভেসে গিয়েছিল।
এই বর্ষায় আদিব শহরের ক্লান্তি থেকে পালিয়ে এসেছে। এসেছে সেই পুরনো তালগাছ, পুকুর পাড়, আর নীলার স্মৃতিকে খুঁজতে। কিন্তু গ্রামের চিত্র বদলে গেছে। আগের মাটির ঘর, বাঁশের বেড়া, কাদামাখা উঠোন—সবই আজ নতুন করে গড়া।
নীলার ঘর খুঁজে বের করতেই শুনল একটা খবর—
নীলা এখন আর নেই। গত বছরের এক বৃষ্টির রাতেই চিরবিদায় নিয়েছে সে। গ্রামের মানুষ বলে, সে প্রায়ই তালগাছের নিচে বসে থাকত, বৃষ্টির দিনে একা একা ভিজত, কাঁদত।
আদিব স্তব্ধ হয়ে যায়। বুকের ভেতর যেন বজ্রপাত হয়।
তালগাছের নিচে বসে ছিল সে। হঠাৎ এক বৃদ্ধা তার পাশে এসে বসেন। নীলার মা।
তিনি আদিবকে দেখেই চিনে ফেলেন, বলেন—
— “তুই এলি অবশেষে। নীলা তোকে ভীষণ বিশ্বাস করত। তোকে নিয়ে একটা চিঠি লিখেছিল সে, আমি রেখে দিয়েছিলাম।”
তিনি আদিবের হাতে তুলে দেন হলদে হয়ে যাওয়া খাম। বৃষ্টির ফোঁটা তখন খামের গায়ে পড়ছে।
চিঠিতে লেখা ছিল—
“আদিব,
যদি কখনও ফিরে আসিস, আমি থাকব কিনা জানি না। কিন্তু বর্ষা আসলেই আমি তোকে খুঁজে বের করব। বৃষ্টির ফোঁটায় ভাসিয়ে দেব আমার অনুভব।
তোকে আমি ভালোবেসেছি নিঃশব্দে, নিঃশেষে।
– নীলা”
চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। সেটা কি বৃষ্টির ফোঁটা, নাকি অনুশোচনার অশ্রু—কে জানে!
সেই দিন থেকে আদিব প্রতিবছর বর্ষায় ফিরে আসে চর শালিকপুরে। তালগাছের নিচে বসে, নীলার চিঠি হাতে করে ভিজে। বৃষ্টি পড়ে, বাতাস বয়, আর হয়তো দূরে কোথাও নীলা ম্লান হেসে বলে—
“আমরা তো এখনও শেষ হইনি।”