পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে কেউ হাসলেন, কেউ বললেন “আলহামদুলিল্লাহ্”, কেউ আবার তাঁকে সরাসরি জাহান্নামে পাঠালেন। কী আশ্চর্য! একজন শান্তিকামী, মানবতাবাদী, শিশুপ্রেমী মানুষ চলে গেলেন, আর আমরা উল্লাস করলাম?
এই মানুষটিই তো ছিলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় কণ্ঠস্বর, মানবতার পক্ষে অবিচল এক দিশারি। এমনকি মুসলিম দুনিয়াতেও তাঁর মতো আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলার মতো নেতার দেখা একজনও মেলে না। তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?
মৃত্যুর ঠিক আগের দিন, ইস্টার সানডেতে, পোপ ফ্রান্সিস গাজার যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। রোমের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ব্যালকনি থেকে দেওয়া এক ছোট্ট বার্তায় তিনি বলেছিলেন—
“যুদ্ধ বন্ধ করুন। জিম্মিদের মুক্তি দিন। আর যারা শান্তির ভবিষ্যৎ চায়, সেই ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান।”
এই বার্তা কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, ছিল তাঁর প্রাণের আর্তি। ৮৮ বছর বয়সী পোপ চিকিৎসকের পরামর্শে ইস্টারের মূল আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেননি, তবু সবার শেষে ‘উরবি এট অরবি’ বার্তায় মানবতার পক্ষ নিয়ে গর্জে ওঠেন তিনি।
তিনি বহুবার গাজার শিশুহত্যার নিন্দা করেছেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে গাজার পরিস্থিতিকে বলেছিলেন “নিষ্ঠুরতা”। তিনি হামাসের হাতে আটক বন্দীদের মুক্তির দাবিও তুলেছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিস শুধু কথার মানুষ ছিলেন না। ২০১৬ সালে গ্রিসের লেসবস দ্বীপ থেকে তিনি নিজ হাতে ১২ জন সিরীয় মুসলিম শরণার্থীকে ভ্যাটিকানে নিয়ে আসেন, যাদের মধ্যে ৬ জন ছিল শিশু।
২০১৫ সালে ভ্যাটিকান ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় -যা ইতিহাসে এক বড় পদক্ষেপ।
তিনি বলতেন -“যারা অস্ত্র বিক্রি করে, তারা যুদ্ধ চায়।” তাঁর কাছে অস্ত্র ব্যবসা ছিল মানবতার প্রতি অবমাননা। আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন -“মানবতা রক্ষার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম নেই।”
২১ এপ্রিল ২০২৫, ইস্টার সোমবারে, এই মহান হৃদয়ের মানুষটি পৃথিবীকে বিদায় জানান। তাঁর মৃত্যুর পর যারা হাসতে পারলেন, তাঁদের হৃদয় কবে মরেছিল, তা হয়তো তাঁরাই জানেন না। এই আনন্দ, এই ঘৃণা -আমাদের মানবিক পতনের বড় নিদর্শন।
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও আমরা ভুলে গেছি -যিশু খ্রিস্ট আমাদের কাছে ইসা (আ.) নবী। খ্রিস্টান ও মুসলমান -দুই ধর্মই তাঁকে শ্রদ্ধা করে। তাহলে পোপের মৃত্যুতে এমন অমানবিক উল্লাস কীসের?
পৃথিবীটা ক্রমশ অন্ধকারে ধাবমান। পোপ ফ্রান্সিসের মতো মানুষদের জন্যই এখনো কিছু আলো টিকে আছে। যারা সেই আলো নিভিয়ে দেন, তারা মানুষ হিসেবে নিজেদের অযোগ্যতা নিজেরাই প্রমাণ করেন।
এই পৃথিবী এমনতর ঘৃণার নয়, ভালোবাসার। পোপ ফ্রান্সিস সেটাই শেখাতে চেয়েছিলেন।
লেখক: সাংবাদিক
২১ এপ্রিল ২০২৫