Posts

গল্প

বৃষ্টির শেষ পাতা

April 22, 2025

Dider Akmol

100
View

বাইরে তখন বৃষ্টি। ঘরের জানালা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। বিদ্যুৎ যাওয়ার আশঙ্কায় ফোনটা চার্জে দিয়ে দেয় রনি। কয়েকদিনের গরমের পর হঠাৎই এমন বৃষ্টি—আকাশ যেনো ঝাঁপিয়ে পড়েছে শহরের বুকে।

পরশু বিয়ে। চার বছরের ভালোবাসা ঘরে তুলবে সে। ঘরজুড়ে উৎসবের আমেজ, হাসি, হুল্লোড়। ছোট বোন পায়েল তো রীতিমতো পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে—তবু তার মনে একটুখানি ভয়, “ভাবি এলে ভাইয়া আমায় ভুলে যাবে না তো?”

রনি জানে, পায়েলই ওর কলিজার সবচেয়ে নরম টুকরো।

গাজীপুরে তখনো বৃষ্টি নামে না, তবু সিমি যেন অনুভব করতে পারে বরিশালের প্রতিটি জলফোঁটা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।

"টুন"—রনির ফোনে চারুর ছবি। সেজেগুজে প্রফুল্ল মুখ। সিমিকে মেসেজ দিল সে, “একটু গান শোনাও না...” সিমি হেসে ফেলে—"আবার শুরু হইছে পাগলামি!" তবুও ফোনের অপর প্রান্তে গান জুড়ে দেয় সে। সেই পরিচিত গলা—রনির মনের ঝড় ঠান্ডা করে দেয়।

রাতের খাওয়া শেষে, ঘুমিয়ে পড়ে রনি। কিন্তু চোখের পাতায় ভেসে ওঠে পুরোনো স্মৃতি। প্রথম পরিচয়—ফেসবুক। চুপিচুপি ভালোবাসা। ঝগড়া, মান-অভিমান, মন গলানো গান—চার বছরের এক রঙিন পথ।

সকালবেলা রনির ঘুম ভাঙে মায়ের ডাকে। ফোন হাতে নিয়েই সিমির মেসেজ দেখে—কয়েকটা লাইক ইমোজি একসাথে। জানত, তার পাগলিটা অভিমান করেছে। হেসে ফেলল। আজ অনেক কাজ—মেহমান সামলানো, কেনাকাটা। পায়েল ভাবির জন্য বিশেষভাবে একটি শাড়ি বেছে নেয়। রনি পছন্দ করে ফেলে কয়েকটি বই—সিমির প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, নিজের পছন্দ “নরকের কবি”, আর একটা বই—লেখক অচেনা, কিন্তু নামটা বড় তীব্র—“উপন্যাস এর শেষ পাতার গল্প”। তারপর রনি পায়েলকে এবং পরিবারের লোকজনকে একটি গাড়িতে করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। আর রনি বই এবং শাড়ী নিয়ে বসে যায় একটি টং এ-

রাতে টঙের দোকানে চা খেতে খেতে ভাবছিল, "কাল বইগুলো দিই সিমিকে, ও খুব খুশি হবে।" হালকা বৃষ্টি পড়ছে—ছাতা নেই, তবুও বুকের ভেতরে এক আলোর উচ্ছ্বাস।

রিকশায় উঠে পড়ল সে। পলিথিন মুড়ে বসে, কল্পনায় দেখছে—সিমি কেমন দেখাবে বধূ সাজে? হালকা মেকআপে, লাল বেনারসিতে, কপালে ছোট্ট টিপ…

তখনই…

একটা মালবাহী ট্রাক আচমকা ধাক্কা দেয় রিকশাটিকে। মুহূর্তেই উল্টে পড়ে যায় রনি। রাস্তায় ছিটকে পড়ে। পাশ দিয়ে আসা একটি বাস… চাকা ঘোরে। এক পলক। আর কিছু বোঝার আগেই…

চুপ।

চারপাশে চিৎকার। রক্তে রঞ্জিত রাস্তায় পড়ে আছে রনি। বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, শাড়িটা রিকশার পেছনে আটকে রইল। রনির চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে।

অচেনা লেখকের বইটির শেষ পাতাটি বাতাসে উড়ে গিয়ে খুলে গেল—

“একসাথে থাকব বললেই কি হয়? নিয়তি যদি একসাথে থাকতে না দেয় আমাদেরকে? সব কিছুর কি পূর্ণতা পেতে হয়? আমাদেরটা না হয় উপন্যাসের শেষ পাতা হয়েই থাকলো…”

বৃষ্টি থামে না। পুরো শহর যেন কাঁদছে—এক তরুণ প্রেমিকের হঠাৎ বিদায়ে।

সিমির ফোনে তখন একের পর এক মিসড কল। একটা ম্যাসেজ আসে—পায়েল লিখেছে, “সিমি আপু... ভাইয়া... ভাইয়া আর নেই।”

হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। চোখে জল নেই। শব্দ নেই। শুধু বুকটা ফেটে যাচ্ছে।

ঘরের সব আলো নিভে আসে।

তার ফোনে সিমি বারবার রনির মেসেজগুলো খুঁটে খুঁটে দেখছিল। এক এক করে সব মেসেজ পড়ছিল, যেন তার শেষ সাক্ষাৎ পাওয়ার আশায়। সর্বশেষ মেসেজ ছিল রনির পাঠানো গান—"অন্ধ দেয়াল"। সে গানের কথা মনে পড়তেই সিমির চোখে জল এসে গেল।

"সোনার বাংলা সার্কাস, অন্ধ দেয়াল, এই গানে গা ভাসাতে, আমি ভীষণ ভালবাসি তোমায়..."

এখন আর রনির মেসেজগুলো সে কোনোভাবেই উত্তর দিতে পারে না। সে জানে, আর কখনোও রনি ফিরে আসবে না। সবই ফেলে রেখে গেছে সে—তার হাসি, তার কথা, তার ছোট ছোট ঝগড়া, রনির পাগলামি। সেই ছোট ছোট অভিমান এখন তার জীবনের বড় যন্ত্রণা।

পরদিন, যখন রনির পরিবারের কাছে যায়, কেউ কিছু বলতে পারে না। পায়েল এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “তোমায় নিয়ে ভাইয়া অনেক কিছু বলত… খুব খুশি ছিল... শেষদিন পর্যন্ত শুধু তোমার কথাই বলেছে।”

সিমি চুপ করে থাকে। তার চোখের জল নেই, কিন্তু তার ভেতরটা যেন ধ্বসে পড়ছে।

রনি একদিন বলেছিল, “আমি না থাকলেও, তুমি যেখানে আছ, আমি সেখানেই আছি। অনুভবে খুঁজে নিও আমাকে।”

সেই অনুভবেই সে বেঁচে থাকে এখন।

রনির শরীর না থাকলেও, ভালোবাসা এখনো তাজা। জীবন থেমে গেছে, তবুও একটা ভালোবাসা—"উপন্যাসের শেষ পাতা" হয়ে রয়ে গেছে। চিরকাল। আর হ্যাঁ, কখনো হয়তো রনি আর ফিরবে না, কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে সে জানবে—রনি তার পাশে ছিল, আছে, এবং থাকবে।
 

Comments

    Please login to post comment. Login