Posts

গল্প

দোয়েলের নিজের আকাশ

April 22, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

152
View

দুপুরের আলোটুকু ঘরজোড়া নিস্তব্ধতার গায়ে চিৎকার করছিল। পুরনো কাঠের আলমারির ওপরে জমে থাকা ধূলোর মতোই সময় থমকে আছে দোয়েলের বাপের ভিটেয়। সাত বছর আগেই বাবা মারা গেছেন। মা, সোহাগী বেগম, এখনো সকালের আজান শোনার পর পরই উঠেন, মাটির উঠোনে জল ছিটান, তারপর বাবার ছবি দেখে চুপিচুপি বলেন—“তোমার দোয়েল ঠিক তোমার মতোই হয়েছে।”

কিন্তু এই কথা শুনলে দোয়েলের বুকের ভেতরটা খালি হয়ে যায়। সে বাবার মতো হতে চায়নি। সে চেয়েছিল নিজের মতো -স্বাধীন, দৃঢ়, নিজের অধিকারে দৃপ্ত হয়ে উঠতে।

অদ্ভুত এক নীরবতা ঘিরে থাকে ভিটেটাকে -যেন শোক আর স্মৃতির চুপচাপ সহাবস্থান। এই ভিটের প্রতিটি দেয়ালে, দরজায়, এমনকি সিঁড়ির কিনারায়ও লেগে আছে দোয়েলের শৈশব। আর সেই শৈশবের গভীরতম জায়গায় যিনি ছিলেন ছায়ার মতো, তিনি আজ মৃত—বাবা, শামসুল হক মোল্লা।

মা জানেন না, দোয়েল বাবার মতো নয়—সে তার চেয়েও বেশি কিছু হতে চেয়েছে। সে চেয়েছে নিজের মতো মানুষ হতে, নিজের মতো পথ গড়তে, আর সবচেয়ে বেশি -চেয়েছে নিজের অধিকারে দাঁড়াতে।
সাত ভাইবোনের সংসার। ছয়জন ভাই, একমাত্র মেয়ে দোয়েল।

ছোটবেলায় বাবা দোয়েলের হাত ধরে বলতেন—
“তুই ম্যাজিস্ট্রেট হবি, মা।”
সেই স্বপ্ন নিয়ে শহরে পাঠানো হয়েছিল তাকে।
শিক্ষিত, মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী হয়ে সে ফিরে এসেছিল গ্রামের সেই কাঁচা পথ ধরে।
কিন্তু বাবার মৃত্যুপরবর্তী শোকসভা পার হওয়ার আগেই শুরু হয় হিসেবের খেলা।
ভাইয়েরা বসে দলিল নিয়ে, জমির কাগজ নিয়ে। দোয়েল বুঝে ফেলে, তার নাম সেখানে নেই।
মা চুপ।
ভাইয়েরা বলে—
— “তুই তো জামাইয়ের ঘরের লোক, তোর আবার জমির দরকার কী?”
— “মেয়েরা জমি পায় না, কখনোই পায়নি। তুই তো জানিসই।”
— “বাবা তোকে ভালোবাসতেন, কিন্তু উত্তরাধিকার তো ধর্মের হিসাবেই চলে।”

সেই রাত দোয়েলের কাছে নিঃশ্বাসবিহীন এক অন্ধকার রাত হয়ে আসে। চাঁদ ছিল, কিন্তু সে জানালায় তাকায়নি। মা যখন বলেছিলেন,
— “মেয়ে হয়ে ভাইদের সঙ্গে মামলা করবি? মানুষ কী বলবে?”
দোয়েল শুধু বলেছিল,
— “মানুষ নয় মা, ইতিহাস কী বলবে, আমি তা নিয়ে ভাবি।”

তিন বছরের দীর্ঘ মামলা। প্রতিদিন আদালতে হাজিরা, তির্যক কথা, গ্রাম্য গঞ্জনা—সবকিছু সামলে দোয়েল দাঁড়িয়ে ছিল মাটির পাশে, স্মৃতির পাশে, নিজের অধিকারের পাশে।

অবশেষে এক বর্ষাচ্ছন্ন দুপুরে আদালত রায় দেন—
“দোয়েল আক্তার, কন্যা হিসেবে পিতার সম্পত্তিতে সমানভাবে অংশীদার হবেন।”
সেদিন গ্রামের আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল।
কিন্তু দোয়েলের চোখে ছিল এক অন্যরকম রৌদ্র—যা কেবল জয়ীর নয়, প্রাপ্যের ন্যায্যতা অর্জনের দীপ্তি।
ভাইয়েরা কেউ কথা বলেনি সেদিন।

তবে মাসখানেক পর ছোট ভাই ইমরান এসে বলেছিল—
— “দিদি, তুই আইনের কাছে দাঁড়িয়ে আমাদের শিখিয়ে দিলি—ভালোবাসার মানে সমানাধিকার ছাড়া অসম্পূর্ণ।”

আজ দোয়েল গ্রামে একটি ‘নারী অধিকার সহায়তা কেন্দ্র’ চালায়। পাটকাঠির বেড়ার ভেতর মেয়েরা আসে, জমির কাগজ নিয়ে, প্রশ্ন নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে।

দোয়েলের নাম এখন কেবল দলিলের পাতায় নয়—
গাঁয়ের মেয়েদের চোখে, সাহসে, উচ্চারণে।
লোকেরা বলে,
“দোয়েল পাখি শুধু গান গায় না, সে নিজের আকাশটাও খুঁজে নেয়—যেখানে মেয়েরা কেবল দায়িত্বে নয়, অধিকারেও সমান।"

লেখক: সাংবাদিক 
২২ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login