Posts

গল্প

পুষ্প ডাঙ্গার পুকুরঘাট

April 22, 2025

journalist tuhin

71
View


(একটি গ্রামীণ পটভূমিভিত্তিক গল্প)

১. শুরু: গাঁয়ের ছায়াঘেরা সকাল
পুষ্পডাঙা গ্রামটা যেন নদীর বুকে আঁকা এক ছায়াপথ। পূর্বদিকে বড়সড় খাল, পুবালি বাতাসে শিস বাজে ঝোপ-জঙ্গলে। আর গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক বটগাছ, যার ছায়াতেই পুকুরঘাট। এই পুকুরঘাট ঘিরেই গাঁয়ের সকাল শুরু হয়, বিকেল গড়িয়ে যায়, আর জীবনের অনেক গোপন কাহিনি সেখানে চাপা পড়ে থাকে।

পাখির বয়স তখন ষোল। মায়ের সঙ্গে কলস নিয়ে ঘাটে আসে, সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে, পায়ের নিচে কাদা-মাটি। তার চোখে আলো, মুখে একরকমের আভিজাত্য, যদিও গরিব ঘরের মেয়ে।
আর রফিক তখন কলেজে পড়ে, চেহারায় গ্রাম্যতা থাকলেও চোখে শহরের স্বপ্ন। ছুটিতে বাড়ি এলে পুকুরঘাটে বসে থাকে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, আর পাখিকে দেখে।

সেই দেখা ধীরে ধীরে অভ্যাসে বদলে যায়। একদিন হঠাৎ রফিক পাখিকে জিজ্ঞেস করে,
– তোমার নাম পাখি কেন জানো?
পাখি লজ্জা পায়, বলে না কিছু।
রফিক বলে, – কারণ তুমিই এই গ্রামের একমাত্র স্বাধীন পাখি।

সেই থেকে তাদের মাঝে এক ধরনের চুপিসারে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। কথা হয় না খুব বেশি, তবু চোখে চোখে কথা হয়, হাসিতে মেলে বিশ্বাস।

পুকুরঘাট ছিল তাদের স্বপ্নের আড়াল।

২. মধ্য: সময়, শহর, বিচ্ছেদ
দিন যায়, মাস পেরোয়। বর্ষা আসে, আবার যায়।
গ্রামের অন্যরাও বদলাতে শুরু করে। কাদির মোল্লা জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ায়, গ্রামে শহুরে লোকের যাতায়াত শুরু হয়। খাস জমির দখল নিয়ে গোলযোগ বাড়ে।

এদিকে রফিক ঢাকা শহরে চাকরি পায়। প্রথমে কনফিডেন্স কম ছিল, কিন্তু কিছুদিন পর একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো চাকরি জোটে। যাওয়ার আগে সে পাখির হাতে দেয় একটা পুরনো খাম,
– এটা খোলো পূর্ণিমার রাতে।

পাখি চুপচাপ নেয়। বলে না কিছু, শুধু চোখে জল টলমল করে ওঠে।

রফিক শহরে চলে যায়।
সপ্তাহে একবার করে চিঠি আসে, কখনও ছবি, কখনও প্যাকেটে শহরের চকোলেট।
কিন্তু বছর ঘুরতেই চিঠি আসা কমে যায়, পাখির চিঠি ফেরত আসে।
শহর রফিককে বদলে দেয়।

পাখি কিন্তু অপেক্ষা করে। পুকুরঘাটে এসে বসে, পুরনো খামটা বারবার পড়ে, ভেজা চোখে চেয়ে থাকে জলে।

৩. সমাপ্তি: ফিরে দেখা, ফিরে না পাওয়া
পাঁচ বছর কেটে যায়।
পুষ্পডাঙা এখন আধুনিকতা ছুঁয়েছে—চায়ের দোকানে টিভি এসেছে, কিছু বাড়িতে সৌর প্যানেল।
কিন্তু সেই পুকুরঘাটটা আছে যেমন ছিল, একটুও বদলায়নি।

এক বর্ষার রাতে, খালের জল বাড়ে। পাখি তখন পাশের গ্রামে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল। ফেরার পথে নৌকা উল্টে যায়। তার লাশ মেলে না—শুধু একটা কলস আর ভেসে আসা ওড়না।

গ্রাম শোকগ্রস্ত হয়। পুকুরঘাটে মাটির নিচে, পাখির বানানো গোপন জায়গায় একটা পুরনো খাম রেখে দেয় তার মা।

আর দশ বছর পর, এক গ্রীষ্মের দুপুরে রফিক ফেরে। চোখে চশমা, মুখে কুয়াশা। পুকুরঘাটে এসে বসে পড়ে।

সে খুঁজে পায় সেই খাম। খোলে—

"তুই থাকিস বা না থাকিস, এই পুকুরঘাটে তোর জন্য একটা হৃদয় রেখে গেছি। একদিন যদি ফিরে আসিস, সেই হৃদয়টা যেন আবার ধুকপুক করে ওঠে..."

রফিক চুপ করে বসে থাকে। পুকুরঘাটের বাতাসে যেন পাখির গলা ভেসে আসে।
সে জানে, সব ফিরে পাওয়া যায় না। তবু ফিরে আসা যায়, চোখে জল নিয়ে, হৃদয়ে দাগ নিয়ে।

পুষ্পডাঙার পুকুরঘাট আজও অপেক্ষায় থাকে—আরো কারো ভালোবাসার গল্প জমে উঠবে বলে।

Comments

    Please login to post comment. Login