সকালটা শুরু হয়েছিল অস্বাভাবিক নীরবতায়।
যেন কোন অদৃশ্য হাত পৃথিবীর কোলাহল মুছে দিয়েছে। পাখিরা ডাকে না, কুকুরের ঘেউ ঘেউ নেই, এমনকি বনের ঝিঁঝি পোকাটাও যেন চুপসে গেছে। সেই নিঃশব্দতার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতি—ঘন হয়ে আসা এক অনিশ্চিত ছায়ার নিচে।
পূর্ব আকাশে তখনো সূর্যের রঙ উঠেনি ঠিকমতো। তার আগেই দিগন্তের ওপর ভেসে উঠেছে কালো ছায়ামেঘ। সেই মেঘ যেন ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে দিগন্তের শেষ রেখাটুকু। প্রথমে সেটা ছিল স্রেফ হালকা ধোঁয়ার মতো, তারপর তা ঘন হলো, কালচে হলো, এবং এক সময় যেন পুরো আকাশটাই ঢেকে ফেলল।
নিচের জমিগুলো আজ অন্যরকম লাগছে। ধানক্ষেত, যা একসময় বাতাসে ঢেউ তোলে, এখন নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খেতের মধ্যে বাতাস নেই—তবু একটা চাপা উত্তেজনা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে।
কোথাও একটা অদৃশ্য ঘড়ি টিক টিক করে গুনে নিচ্ছে সময়, তার ঠিক পরেই কিছু একটা ঘটবে।
বাঁশবন আজ শব্দহীন।
সেই পাতলা বাঁশপাতা, যা বাতাসে বাজনা তোলে, এখন স্তব্ধ। একটা বাঁশ থেকে আরেকটা বাঁশ হেলে পড়ছে না। মনে হচ্ছে, পুরো বনটাই শ্বাস রোধ করে অপেক্ষা করছে, কোন আশ্চর্য ঝড় যেন তার দরজায় কড়া নাড়ছে।
পুকুরের জল তামাটে। মেঘের ছায়া সেখানে চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা হাওয়া এসে জলের ওপর ঢেউ তোলে, কিন্তু সেই ঢেউও যেন নিঃশব্দ। পাড়ে থাকা কলাপাতা কাঁপে না, কচুরিপানার সবুজ পাতাও স্থির।
আকাশ একসময় একরঙা ছিল না। কিন্তু আজ সে শুধু কালো নয়—কালচে বেগুনি, সীসের ধূসর, কোথাও কোথাও বিদ্যুৎচমক লুকোনো সাদা রেখায় আঁকা এক অদ্ভুত চিত্রপট। যেন কেউ বিষণ্ন কল্পনার রংতুলি দিয়ে এক শোকগাথা এঁকেছে দিগন্ত জুড়ে।
এমন দিনের গন্ধও আলাদা। বাতাসে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ নেই, ফুলের সুবাস নেই, শুধু একরকম ভেজা পাতার গন্ধ, যার সঙ্গে মিশে আছে দূর থেকে ভেসে আসা ঝড়ের হুঁশিয়ারি।
দূরের খালের জলও আজ সুর হারিয়েছে। সাধারণত সে ঝিরঝির শব্দে গান গায়, এখন শুধু বয়ে চলে নীরবে—ঠিক যেন কেউ কাঁদছে কিন্তু কান্না শোনানো যাবে না এমন নিষেধ আছে।
আচমকা এক বিদ্যুৎ চমক। পুরো আকাশ যেন এক সেকেন্ডের জন্য খুলে গেল। সব গাছ, খেত, নদী, ঝোপ-জঙ্গল ঝলসে উঠল, তারপর আবার অন্ধকার।
তারপর শুরু হলো গর্জন।
না, কাঁপানো রকম ভয়ংকর গর্জন নয়—বরং এক ধরণের থমকে যাওয়া ডাক, যেন মেঘগুলো নিজেরাও জানে না ঠিক কী বলতে চায়।
বৃষ্টির ফোঁটা তখনো পড়েনি। কিন্তু হাওয়ার গতি বাড়ছে। ধুলো উঠছে পথের ধারে, শুকনো পাতাগুলো ভেসে যাচ্ছে ঘূর্ণির মতো। তালগাছ দুলছে, তার লম্বা শরীর এঁকেবেঁকে উঠে কেমন হাহাকার করছে।
অরণ্যের গা ঘেঁষে থাকা জলাভূমি তখনও নিঃশব্দ। তার ওপরে একজোড়া বক দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না একটুও। যেন তারাও বুঝে গেছে এই দিনের রহস্য। প্রকৃতি যখন এমন অস্বাভাবিক আচরণ করে, তখন প্রাণীরা বেশি শব্দ করে না, বরং চুপ হয়ে পড়ে।
হঠাৎ শীতল বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগে। গন্ধে আছে পচা পাতা, ভেজা কাদা আর আসন্ন ঝড়ের গোপন বার্তা। আকাশ ঘন হয়ে এসেছে এতটাই, যেন তার নিচে মাটি কুঁকড়ে যেতে চাইছে। সূর্যের চিহ্নমাত্র নেই, দিনের আলো আর রাতের অন্ধকারের মাঝখানে এক অনিশ্চিত ধূসরতা নেমে এসেছে।
পাহাড়ঘেঁষা জঙ্গলে তখন গাছেরা নিজেদেরই বুক আগলে রেখেছে। পাতা গুটিয়ে নিয়েছে, ডালগুলো নুইয়ে এসেছে—প্রকৃতি নিজেই নিজেকে সুরক্ষার আবরণে মুড়ে ফেলছে।
সব কিছু এমন নিস্তব্ধ, যেন পৃথিবী নিজের শ্বাস বন্ধ রেখেছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে—
এক ফোঁটা বৃষ্টি।
তারপর আরেক ফোঁটা।
ধীরে ধীরে গাছের পাতা ভিজে ওঠে, খালের বুক টপ টপ করে শব্দ তোলে, বাতাসে আবার প্রাণ ফিরে আসে।
তবে সেই প্রাণে নেই আনন্দ, আছে এক ধরনের ক্লান্তি।
এক দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান যেন।
পৃথিবী ধীরে ধীরে সেজে নেয় বৃষ্টির চাদরে। মাটি ভিজে ওঠে, মেঘ নামে ধীরে ধীরে, সবুজ আবার ঘন হয়, পাখিরা আশ্রয় খোঁজে।
শুধু বাতাস বলে দেয়—এই দিনটা সাধারণ নয়।
এ এক “কালো মেঘের দিন”—
যেদিন প্রকৃতি নিজেই তার গল্প লেখে, মানুষ ছাড়াই।
একটা দিন, যেখানে গাছ, মাটি, বাতাস আর আকাশ মিলে তৈরি করে এক নিঃশব্দ নাটক—নরম, ভারী, অথচ ভয়ঙ্কর সুন্দর।