একটি কাল্পনিক ভ্রমণ কাহিনি |
---
অধ্যায় ১: হঠাৎ আমন্ত্রণ
২০২৫ সালের মে মাস। আমি, আবিদ রহমান, একজন ভ্রমণব্লগার। অজানা, রহস্যময় স্থান খোঁজাই আমার নেশা। আমি এর আগে হিমালয়ের বেস ক্যাম্প থেকে শুরু করে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি পর্যন্ত অনেক জায়গা ঘুরেছি, কিন্তু এমন একটা অদ্ভুত আমন্ত্রণ আগে কখনো পাইনি।
সেদিন সকালে আমার বাসার ডাকবাক্সে একটি চিঠি পাই। চিঠিটা পুরোনো ধাঁচের, হালকা বাদামি রঙের খাম, কালি দিয়ে হাতে লেখা। খুলে দেখি—
“মিস্টার আবিদ,
আপনি কি কুয়াশার দ্বীপে যেতে সাহস করবেন?
যদি হ্যাঁ, তাহলে ১৩ই মে সকাল ৬টায়, চট্টগ্রাম বন্দরের পুরাতন ঘাটে উপস্থিত হোন।
নৌকাটি আপনার জন্য অপেক্ষা করবে।
— কেউ একজন।”
প্রথমে ভেবেছিলাম এটা হয়তো কারো কৌতুক। কিন্তু কৌতূহলই আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। ভেবে দেখলাম, অ্যাডভেঞ্চারই তো চাই! পরদিনই চট্টগ্রামের ট্রেন ধরলাম।
অধ্যায় ২: কুয়াশার মধ্যে অদ্ভুত যাত্রা
১৩ই মে। ভোর ৫:৫০। আমি চট্টগ্রাম বন্দরের পুরাতন ঘাটে উপস্থিত। চারদিক নিস্তব্ধ, একটু ভয়ও করছিল। কুয়াশায় ঢেকে থাকা পুরো ঘাটটা যেন একটা আলাদা জগত।
ঠিক ৬টা বাজতেই একটুকরো ছায়ার মতো একটা কাঠের নৌকা ঘাটে ভিড়ল। মাঝি একজন বৃদ্ধ লোক, মুখে কোন কথা নেই, শুধু চোখে অদ্ভুত এক চাহনি। আমাকে ইশারা করলেন উঠতে। আমি দ্বিধা না করে নৌকায় উঠে পড়লাম।
নৌকাটা ধীরে ধীরে কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যেতে লাগল। চারদিকে এতটাই কুয়াশা যে পাঁচ ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। শব্দহীন, স্রোতহীন পানির ওপর যেন স্বপ্নের মতো ভেসে যাচ্ছি।
প্রায় এক ঘণ্টা পর, হঠাৎ করেই কুয়াশা ছেঁড়া শুরু হলো। সূর্যের আলোর রেখা পড়তেই সামনে এক মনোরম দৃশ্য উদ্ভাসিত হলো—সবুজে মোড়ানো একটা দ্বীপ। দূর থেকে দেখা যায়, দ্বীপটির মাঝখানে ছোট পাহাড়, তার চারপাশে জলধারা, আর চারদিকে ঘন জঙ্গল।
অধ্যায় ৩: দ্বীপের আশ্চর্য জীবন
দ্বীপে পা দিতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। যেন পৃথিবীর বাইরে কোনো জায়গায় এসেছি। বাতাসে হালকা মিষ্টি গন্ধ, অচেনা পাখির ডাক, আর আশেপাশে কোনো মানুষের চিহ্ন নেই।
তবে কয়েক কদম হাঁটতেই দেখা গেল এক সাদা পোশাক পরা এক তরুণী দাঁড়িয়ে। মুখে অদ্ভুত এক হাসি, গলায় বলল, “স্বাগতম, আবিদ। আমরা আপনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।”
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কে? আপনি জানলেন কীভাবে আমি আসব?”
সে বলল, “এই দ্বীপে সব আগন্তুকই পূর্বনির্ধারিত। আপনি আমাদের নির্বাচিত পর্যটক। এবার চলুন, আপনাকে বিশ্রাম নিতে হবে।”
আমাকে একটি আধুনিক কাঠের কটেজে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘরটি জঙ্গলের মাঝখানে হলেও, ভিতরে ছিল সোলার পাওয়ারে চলা লাইটিং, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, এমনকি হালকা ইনফ্রারেড তাপও।
আমি প্রশ্ন করলাম, “এখানে আর কেউ আছে?”
তরুণী বলল, “আছে, তবে তারা সবাই পর্যবেক্ষণ করছে। আপনার পরীক্ষা শুরু হয়েছে।”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা?
অধ্যায় ৪: গোপন গবেষণা কেন্দ্র
পরদিন সকালে আমাকে একটি গলিপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো দ্বীপের এক ভিন্ন প্রান্তে। হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম পাহাড়ের নিচে লুকানো এক সুপার-আধুনিক ল্যাবরেটরি। ভিতরে ঢুকেই চমকে গেলাম—রোবোট, হোলো-প্রজেক্টর, অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি চেম্বার, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সিস্টেম।
আমার গাইড জানাল, “এটি Project KUSHAA—একটি গোপন আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট, যেখানে আমরা মানুষের মানসিক ও মানাবিক আচরণ যাচাই করে দেখি তারা ভবিষ্যতের ‘নতুন পৃথিবীর’ জন্য উপযুক্ত কি না।”
আমি বললাম, “কিন্তু আমাকে কেন?”
সে হাসল, “তুমি প্রকৃতিকে ভালোবাসো, মানুষকে বোঝো, এবং তোমার মধ্যে কৌতূহলের শক্তি আছে। এই পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে, তারা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নতুন গ্রহে বসতি স্থাপন করবে।”
আমি বিস্মিত! তাহলে কি এই দ্বীপটা আসলে একটা ‘টেস্ট জোন’?
অধ্যায় ৫: মানসিক পরীক্ষার শুরু
পরবর্তী কয়েকদিন ধরে আমাকে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হলো। দিনের বেলায় ছিল জঙ্গলের ভেতর দিকভ্রান্ত হয়ে বাঁচার মিশন, রাতে ছিল বিভ্রান্তিকর স্বপ্নের ভেতর বাস্তবতা চেনার খেলা।
একদিন আমাকে ঘন কুয়াশার মধ্যে এক ছায়ামূর্তিকে অনুসরণ করতে বলা হলো। আমি সাহস করে এগোতে লাগলাম। ধীরে ধীরে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। তারপর শুনতে পেলাম মায়ের গলা—“আবিদ, ফিরে এসো!”
আমি থেমে গেলাম। এটা তো হতে পারে না! মা তো ঢাকায় আছেন!
হঠাৎ করেই চারদিক পরিষ্কার হয়ে গেল। সামনে সেই তরুণী দাঁড়িয়ে, বলল, “তুমি পাস করেছো। তুমি নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখেছো। এবার চূড়ান্ত ধাপ।”
অধ্যায় ৬: দ্বীপের শেষ রহস্য
এক রাতে আমাকে এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো। চারপাশে ছিল তারাভরা আকাশ, আর নিচে জ্বলজ্বলে দ্বীপ। হঠাৎ একটা গোলাকার দরজা খুলে গেল পাহাড়ের ভেতরে। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন প্রায় বৃদ্ধ বিজ্ঞানী।
তিনি বললেন, “আবিদ, তুমি এখন জানো না, তবে তুমি ভবিষ্যতের এক ‘নির্বাচিত ব্যক্তি’। আমরা এমন মানুষ খুঁজছি যারা শুধু বুদ্ধিমান নয়, হৃদয়বানও। তুমি সেই একজন।”
আমি বললাম, “তাহলে এই দ্বীপটা কি শুধুই পরীক্ষা ছিল?”
তিনি বললেন, “এই দ্বীপ একটি সিমুলেটেড রিয়েলিটি—তবে বাস্তবের কাছাকাছি। এখানে আমরা তোমার প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, সিদ্ধান্ত আর মূল্যবোধ বিশ্লেষণ করেছি। এই পৃথিবী ধ্বংসের পথে, আর তোমার মতো মানুষদের দিয়েই তৈরি হবে নতুন সভ্যতা।”
আমি চুপ। কথার ভার বুঝে নিতে সময় লাগছে। তিনি আমাকে এক ট্যাব দিলেন—যার ভেতরে শুধু লেখা:
“তুমি প্রস্তুত? সামনে শুরু তোমার সত্যিকারের ভ্রমণ।”
অধ্যায় ৭: ফিরে দেখা, অজানা শুরু
পরদিন সকালে আমি সেই একই কাঠের নৌকায় ফিরে এলাম। মাঝি আবারও কোনো কথা না বলেই আমাকে চট্টগ্রাম বন্দরে নামিয়ে দিল। চারপাশে স্বাভাবিক শহরের কোলাহল, যেন কিছুই ঘটেনি।
কিন্তু আমি জানি, কিছু তো ঘটেছেই। আমার মানসিকতা বদলে গেছে, আমি এখন আর আগের মতো সাধারণ পর্যটক নই। আমার হাতে সেই ট্যাব, যার মাধ্যমে আমি যে কোনো সময় ফিরে যেতে পারি—কুয়াশার দ্বীপে।
তবে সেটা হবে তখনই, যখন পৃথিবীর মানুষ ‘নতুন শুরু’র জন্য প্রস্তুত হবে।