বাংলাদেশে ৯৬ শতাংশ ভূমির মালিক পুরুষেরা, নারীর অধিকারে মাত্র ৪ ভাগ। এই বৈষম্য নিছক সংখ্যার খেলা নয়, বরং মানবাধিকার, ন্যায় এবং সামাজিক সুবিচারের প্রতি বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
সম্পত্তি অর্জন, ভোগ এবং উত্তরাধিকারের অধিকার মানবাধিকার চর্চার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। অথচ বিশ্বব্যাপী বহু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারীদের এই মৌলিক অধিকার এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ধর্মীয় ব্যাখ্যা, সাংস্কৃতিক রীতি এবং পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার ফলে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ এবং প্রান্তিক অবস্থানে রয়ে গেছে। কিন্তু এই বৈষম্যের অবসান না ঘটালে নারীকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও স্বনির্ভর করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার প্রণীত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য হলো, সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপ্তি এবং নারী-পুরুষ এর সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ!
সতেরটি অধ্যায়ে বিভক্ত ৩১৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন কেন দরকার হলো যদিবা দেশের নারীরা প্রাপ্য অধিকার নিয়ে ষোলোকলায় পূর্ণ থাকে?
আসুন আমরা প্রতিবেদনের কিছু অংশ পড়ে আসি। তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম, সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার: সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি। উপ শিরোনাম, 'রাষ্ট্র এবং পরিবারে, সমান হবো অধিকারে'।
নারী উন্নয়নের পথে চ্যালেঞ্জ পরিচ্ছদে বলা হয়েছে, নারী উন্নয়নের পথে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পারিবারিক আইন ও উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা প্রায়শই রক্ষণশীল ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে নারী-আন্দোলন ও নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলো আইনগত সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা রেখে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল হয়রানি, নারীবাদী কর্মীদের বিরুদ্ধে বৈরী মনোভাব এবং উন্নয়ন-সহযোগীদের অর্থায়নে ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
মূলত পারিবারিক আইনে ধর্মীয় বিধিনিষেধ নিয়েই বেশি কথা হচ্ছে। প্রতিবেদন চাচ্ছে সময়োপযোগী সমানাধিকার। অপরদিকে কতিপয় ধর্মীয় গোষ্ঠী চায় পৌরাণিক মূলের অনুগামী থাকতে।
একাদশ অধ্যায়ের শিরোনাম অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার। উপ শিরোনাম 'সমান হিস্যা, সমান অধিকার'।
নারীরা পুরুষের জমির মালিকানা ও ব্যবহারের অধিকার পরিচ্ছদে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে কৃষি-উৎপাদনের সাথে জড়িত অধিকাংশ নারীই ভূমিহীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্রায় ৩২.০৪ শতাংশ নারী গৃহস্থালির সদস্যের জমির মালিকানা রয়েছে, যেখানে মুসলিম নারীদের মধ্যে মালিকানা (৩৪.২৬ শতাংশ) হিন্দু নারীদের (১১.৬৪ শতাংশ) তুলনায় বেশি। বেসরকারি গবেষণানুযায়ী, বাংলাদেশে পুরুষরা ৯৬ শতাংশ জমির মালিক; নারীদের মালিকানায় রয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ জমি। নারীদের ভূমি-অধিকার কম হওয়ার পেছনে পিতৃতান্ত্রিকতা, ভূমি-মালিকানা সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব, ভূমিদস্যুদের কার্যকলাপ, ভূমি-প্রশাসনের দুর্নীতি, বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইন ও প্রাপ্য অংশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারা অন্যতম কারণ।
১৯৯৭ সালে প্রণীত খাসজমি বন্দোবস্ত ও ব্যবস্থাপনা-নীতিমালায় উল্লিখিত কর্মক্ষম সন্তান থাকার শর্তের কারণে বিধবা বা একক নারীরা খাসজমি বন্দোবস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তাহলে যারা গল্প শোনান নারীরা বাবার কাছ থেকে এবং স্বামীর কাছ থেকে সম্পত্তি পান তাই নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি অধিকার পাচ্ছে! তাদের চিন্তা, ধারণা ও কথাবার্তা যে কতটা হাস্যকর তা এই প্রতিবেদনের তথ্যই প্রমাণ করে।
ধর্মীয় বিধান বনাম আইনি ও সামাজিক অগ্রগতির বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত কেমন? ইসলামী শরিয়া আইনে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সাধারণত পুরুষকে নারীর তুলনায় দ্বিগুণ ভাগ দেওয়া হয়। এই বিধান প্রাচীন সামাজিক বাস্তবতার আলোকে প্রণীত হলেও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আজকের সমাজে নারী যেমন অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও সামাজিকভাবে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে উঠেছেন, তেমনি পরিবারে তার দায়িত্ব ও অবদানও পাল্টেছে।
আফ্রিকার তিউনিসিয়ার মতো কিছু দেশ ধর্মনিরপেক্ষ পারিবারিক আইন প্রণয়ন করে নারীর সম্পত্তিতে সমানাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। ২০১৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এস-সেবসি এর উদ্যোগ সামাজিক স্তরে আলোড়ন তুলে। মরক্কো, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশে কিছু আইনি সংস্কার ও রায়ের মাধ্যমে নারীর অধিকার কিছুটা এগিয়েছে, যদিও তা এখনও সীমিত।
মালয়েশিয়ায় মুসলিমদের জন্য শরিয়া আইন এবং অমুসলিমদের জন্য সিভিল আইন প্রযোজ্য। কিছু রাজ্যে প্রগতিশীল রায় এবং নারীবান্ধব নীতিমালা নারী অধিকার প্রশ্নে ইতিবাচক ধারা তৈরি করেছে। ইন্দোনেশিয়াতেও শরিয়া পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়, ফলে অনেক সময় আদালতের রায়ে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকৃত হয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশে এখনো মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। ফলে পুত্র সন্তান দ্বিগুণ ভাগ পেয়ে থাকেন। তবে রেজিস্ট্রেশনকৃত উইল, গিফট ডিড বা আদালতের রায়ের মাধ্যমে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর পক্ষে সমতা নিশ্চিত করা গেছে। নারী অধিকার বিষয়ে সোচ্চার কয়েকটি রায় সমাজে উদাহরণ তৈরি করেছে, যেমনটি বিগত কয়েক বছরে দেখা গেছে।
ভারতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ২০০৫ সালের সংশোধন নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করেছে। খ্রিস্টান নারীরাও অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের সমান উত্তরাধিকার পান। তবে মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে এখনো শরিয়াভিত্তিক আইনই বলবৎ।
নারীর সম্পত্তির অধিকার: এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানবিক প্রশ্নও। নারীর সম্পত্তিতে অধিকার শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, বরং এটি তার মর্যাদা, নিরাপত্তা ও আত্মনির্ভরতার বিষয়। একজন নারী যদি তার পরিবার বা সমাজ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তার সামনে আত্মরক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। অনেক সময় স্বামীর মৃত্যু বা বিচ্ছেদের পর নারীরা নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে শুধু এই কারণে যে, তারা সম্পত্তিতে অধিকার পান না বা তা প্রয়োগ করতে পারেন না।
এছাড়া সম্পত্তিতে অধিকার নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, তাকে পরিবারে এবং সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে। সম্পত্তির মালিকানায় অংশীদার হওয়া মানেই নারীর জন্য অধিকতর নিরাপত্তা, সামাজিক স্বীকৃতি এবং ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।
ধর্মীয় ব্যাখ্যার পুনর্মূল্যায়ন ও বিকল্প পথ বিবেচনা জারি রাখা জরুরি কেন? ধর্মকে সমাজ পরিবর্তনের অন্তরায় না বানিয়ে, বরং প্রগতিশীল ব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীর অধিকারকে সমর্থন করা প্রয়োজন। ইসলামেও এমন ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে যেখানে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নকে প্রাধান্য দিয়ে সমতা নিশ্চিত করা যায়। বিকল্পভাবে উইল, গিফট বা আদালতের মাধ্যমে নারীকে সমানাধিকার দেওয়া সম্ভব, যেমনটা বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা মানেই একটি সমাজে সাম্য, ন্যায় এবং মানবিক মর্যাদার বাস্তবায়ন। এটি কেবল নারীর নয়, সমগ্র সমাজের উন্নয়নের ভিত্তি। কাজেই নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অসঙ্কোচ ও নিশংসয়ে সকলপক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থন পাওয়া উচিত।
ধর্ম, সংস্কৃতি বা আইনের দোহাই দিয়ে নারীর প্রতি যেকোনো প্রকার অবিচারকে চিরস্থায়ী করা অনৈতিক ও অগ্রহণযোগ্য। এখন সময় এসেছে বৈষম্যের শিকল ছিঁড়ে নারীর প্রকৃত অধিকার স্বীকৃত করার। সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার কেবল নারীর মুক্তি নয়, বরং একটি সমাজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত। ধর্মীয় ব্যাখ্যার নতুন পুনর্মূল্যায়ন, আইনগত সংস্কার এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। তিউনিসিয়ার মতো উদাহরণ দেখায় -ইচ্ছা থাকলে পথ বের হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সেই পথে হাঁটতে প্রস্তুত কি না?
রেফারেন্স:
• Al Jazeera: Tunisia proposes equal inheritance for women (2018)
• Human Rights Watch: Morocco: New Family Code a Step Forward (2004)
• UN Women: Property and Inheritance Rights of Women in Indonesia
• BLAST: Property Rights and Muslim Women in Bangladesh
• India Code: Hindu Succession (Amendment) Act, 2005
• Supreme Court of India: Vineeta Sharma vs Rakesh Sharma, 2020
• Sisters in Islam (SIS) – Malaysia
• নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনে প্রতিবেদন -১৯ এপ্রিল ২০২৫
লেখক: সাংবাদিক
২২ এপ্রিল ২০২৫