Posts

উপন্যাস

তোমার জন্য....(পর্ব -৪১)

April 22, 2025

Boros Marika

99
View

তৃষার মুখে এত সহজ, এত নিঃস্পৃহ একটা কথা—
“তুমি দেরি করে ফেলেছ, আরিয়ান…”
এই কথাটা যেন শিলালিপির মতো ভেসে থাকলো বাতাসে।

আরিয়ানের চোখ কাঁপলো, ঠোঁট কাঁপলো, কিন্তু কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।

তৃষা উঠে দাঁড়াল। তার চেহারায় কোনো অভিমান নেই, কোনো অভিশাপও নেই—
আছে শুধু একটা নিঃশব্দ সিদ্ধান্ত।
সে চলে গেলো, পেছন ফিরে তাকালো না। যেন সবকিছু একবারে মুছে ফেলেছে মনের ভিতর থেকে।

আর এদিকে মিস্টার আমান…
তার ভিতর যেন আগুন জ্বলছিল।
এক অদ্ভুত হিংসা, যার ব্যাখ্যা সে নিজেও খুঁজে পাচ্ছিল না।

"এটা তো হুট করেই বিয়ে," সে ভাবলো, "তৃষার সাথে আমার কোনো গভীর ইতিহাস ছিল না, তাহলে কেনো আমি এভাবে জ্বলে উঠছি?"

তবুও সে বুঝে গেলো—
এই মেয়েটার চোখে কোনো শব্দ না থাকলেও, ওর নীরবতায় একধরনের অধিকার আছে, যেটা সে অস্বীকার করতে পারছে না।
আর সে অধিকার… আরিয়ানকে ছাড়া কারো নেই।
সেই মুহূর্তে ঘরের পরিবেশ একেবারে ভারী হয়ে আছে।

কেউ কিছু বলছে না। শুধু একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
আরিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে, হাতের ব্যান্ডেজটা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, তবু চোখে কষ্টের চেয়ে বেশি একরকম ভয় আর ভাঙা ভরসা।

তৃষা নিজেকে শক্ত করে বসে আছে। তার দৃষ্টি নিচু, কিন্তু ভিতরটা যেন শত শব্দে চিৎকার করছে।

মিস্টার আমান দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে, বুকের ভেতর একটা টানাপোড়েন। তিনি বললেন—

"এখন যা হয়েছে, তার পরিণতি নিয়ে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। এই অবস্থায় তৃষাকে নিয়ে আমি বাসায় যেতে পারি না, যদি না সে নিজে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে।"

তৃষার বাবা আস্তে বললেন,
"আমাদের পরিবারের মান-সম্মান, মেয়ের ভবিষ্যত সব কিছু মিলিয়ে... এখন যদি কিছু না করি, তাহলে হয়তো কোনো দিনই আর সে শান্তি পাবে না।"

আরিয়ানের মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
"আমার ছেলেটা যা করেছে ভুল... কিন্তু তৃষা যে আজ ওর জায়গায় অন্য কারো বউ, এটা কীভাবে মেনে নেবে ও?"

এরপর আমানের দাদি শান্ত কণ্ঠে বললেন—
"এখন আর বিয়ে বাতিল করা সম্ভব নয়। আমি আমার বউকে নিয়ে যেতে চাই, তবে... তৃষার সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় কথা।"

এভাবে কথা হতে থাকে।
কারও চোখে কষ্ট, কারও চোখে লজ্জা, আবার কারও চোখে অজানা প্রশ্ন।

তৃষা ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে গেলো। চারপাশে নিস্তব্ধতা। সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে—কেউ কৌতুহলভরে, কেউ বিস্ময়ে, কেউ ব্যথায়।

তৃষা এক পা এগিয়ে এসে বললো:

"আমার আজ বিয়ে হয়েছে… মিস্টার আমান এর সাথে। এই বিয়েতে আপনারা সবাই সাক্ষী। তাই এখন আমার কর্তব্য, আমার দায়িত্ব ওর সাথেই যাবার।"

তার কণ্ঠ খুব ঠান্ডা, কিন্তু চোখে চোখে একরাশ বেদনা।

"আমি চেয়েছিলাম… আরিয়ান এর সাথে ভালোবেসে বিয়ে করতে। কিন্তু সেই গল্প আজ আর রইলো না। আমি কারো অবহেলার মূল্য আর নিজের সম্মান দিয়ে দিতে পারি না।"

এক মুহূর্ত চুপ থেকে তৃষা চোখ তুলে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো—

"তুমি দেরি করে ফেলেছো, আরিয়ান। শুধু সময়ে না… বিশ্বাসে, প্রতিশ্রুতিতে, ভালোবাসাতেও।"

আরিয়ান ভেতর থেকে ছিঁড়ে যেতে যেতে শুধুই তাকিয়ে রইলো।

তৃষা এবার ধীরে ধীরে আমানের দিকে এগিয়ে গেলো, যেন নিজের ভাগ্যকেই মেনে নিচ্ছে।

বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এলো।

সবার চোখে পানি। কেউ মুখ লুকিয়ে কাঁদছে, কেউ সামনে দাঁড়িয়ে হেসে বিদায় জানাতে গিয়ে বারবার গলা আটকে যাচ্ছে। মায়ের কোলে মাথা রেখে তৃষা একটুও কাঁদলো না। কাঁদতে পারলো না।

তার মুখটা পাথরের মতো শক্ত—ভেতরে জ্বলছে অগ্নিগিরির মতো চাপা কান্না, কিন্তু বাইরে সে নিঃস্পৃহ।

চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু জমে ছিল, কিন্তু সেটা গড়িয়ে পড়েনি। যেন সে নিজেকেই বলে দিচ্ছে:

“তৃষা, এখন কাঁদলে দুর্বল হবে… আর এখন দুর্বল হওয়ার সময় নয়।”

তৃষা ধীরে ধীরে মা-বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলো, কিন্তু কোনো শব্দ করলো না। মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ভালো থেকো মা… যেভাবেই হোক, সুখী হবার চেষ্টা করো।”

তৃষা শুধু মাথা নেড়ে চুপ করে রইলো।
আমান সামনে এসে দাঁড়াল। তার চোখেও ক্লান্তি, বিভ্রান্তি, কিছুটা অপরাধবোধ, কিছুটা দ্বিধা।
তবে আজ সে কিছু বললো না, শুধু হাত বাড়িয়ে দিলো।
তৃষা সেই হাতটা ধরলো, নিঃশব্দে।

আর ঠিক তখনই, পিছন থেকে একটা গাড়ির দরজা সজোরে বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো।
সবাই ঘুরে দেখলো, আরিয়ান দাঁড়িয়ে। চোখের কোনা লাল, চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।
তৃষা তার দিকে একবারও তাকালো না।

সে কেবল আমানের পাশে দাঁড়িয়ে গাড়িতে উঠলো—বিদায় নিলো তার সেই পুরনো ভালোবাসা, ভেঙে ফেলা স্বপ্ন আর একটা অধ্যায়ের…

চলবে.......

Comments

    Please login to post comment. Login