ব্রিজ ব্যাংক: আর্থিক স্থিতিশীলতায় অস্থায়ী সেতু
ড. মো: তৌহিদুল আলম খান
ব্রিজ ব্যাংক আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল, যা আর্থিক সংকটে থাকা ব্যাংক বা আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্থায়ীভাবে সচল এবং স্থায়ী সমাধানের আগ পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম ও গ্রাহকদের সেবা প্রদানঅব্যাহত রাখে। এটি মূলত একটি অস্থায়ী সেতু, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকাপালন করে। পাশাপাশি গ্রাহকদের আস্থা অটুট রাখে। বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রস্তাবিত ব্যাংক রেজল্যুশনঅর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ব্রিজ ব্যাংকের ধারণা আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এ নিবন্ধে ব্রিজ ব্যাংকের ধারণা, উদ্দেশ্য, প্রক্রিয়া এবং এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তাই আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রিজ ব্যাংক কৌশল সাধারণত তখন প্রয়োগ করা হয় যখন কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটেপড়ে এবং স্বাভাবিকভাবে তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে অক্ষম হয়। এ পদ্ধতিতে একটি অস্থায়ী ব্যাংক বা ব্রিজব্যাংক গঠন করা হয়, যা সংকটগ্রস্ত ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িকভাবে পরিচালনা করে। ব্রিজ ব্যাংকের মূল লক্ষ্যহলো ব্যাংকটির পুনর্গঠন, বিক্রয় বা স্থায়ী সমাধানের আগ পর্যন্ত এর কার্যক্রম সচল রাখা। এ ব্যাংক সাধারণতকেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরাসরি সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকটির আর্থিক পুনর্গঠন, সম্পদব্যবস্থাপনা এবং দায়বদ্ধতা নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যায়।
ব্রিজ ব্যাংকের ধারণা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ করা হয়েছে। যেমন ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিকসংকটের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিজ ব্যাংক এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কার্যক্রম সচল রাখা হয়েছিল।বাংলাদেশেও সম্প্রতি প্রস্তাবিত ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ব্রিজ ব্যাংকের ধারণাটি প্রাসঙ্গিক হয়েউঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাবিত (ড্রাফট) অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, দুর্বল বা সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর সমাধানের জন্যব্রিজ ব্যাংক গঠন করা হবে। এ ব্রিজ ব্যাংকগুলো অস্থায়ীভাবে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করবেএবং এর গ্রাহকদের সেবা প্রদান অব্যাহত রাখবে। ব্রিজ ব্যাংকগুলো সংকটগ্রস্ত ব্যাংকের সম্পদ ও দায়বদ্ধতাব্যবস্থাপনার দায়িত্বও গ্রহণ করবে।
ব্রিজ ব্যাংকের প্রক্রিয়াটি সাধারণত নিম্নলিখিত ধাপগুলো অনুসরণ করে:
সংকটগ্রস্ত ব্যাংক চিহ্নিতকরণ: প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সংকটগ্রস্ত ব্যাংক চিহ্নিত করে। এটিসাধারণত ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা, মূলধনের ঘাটতি বা অন্যান্য আর্থিক সূচকের ভিত্তিতে করা হয়।
ব্রিজ ব্যাংক গঠন: সংকটগ্রস্ত ব্যাংক চিহ্নিত হওয়ার পর একটি ‘ব্রিজ ব্যাংক’ গঠন করা হয়। এ ব্রিজ ব্যাংকসংকটগ্রস্ত ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িকভাবে পরিচালনা করবে।
কার্যক্রম পরিচালনা: ব্রিজ ব্যাংক সংকটগ্রস্ত ব্যাংকের গ্রাহকদের সেবা প্রদান অব্যাহত রাখে এবং এর সম্পদ ওদায়বদ্ধতা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
পুনর্গঠন বা বিক্রয়: ব্রিজ ব্যাংক সংকটগ্রস্ত ব্যাংকটির পুনর্গঠন বা বিক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সময় প্রদান করে।এটি ব্যাংকটিকে আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণের সুযোগ দেয়।
স্থায়ী সমাধান: ব্রিজ ব্যাংকের মাধ্যমে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকটির স্থায়ী সমাধান আনা হয়। এটি হতে পারে ব্যাংকটিরপুনর্গঠন, বিক্রয় বা অন্য কোনো স্থায়ী সমাধান।
বাংলাদেশে ব্রিজ ব্যাংকের প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রস্তাবিত ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল বা সংকটগ্রস্তব্যাংকগুলোর সমাধানের জন্য ব্রিজ ব্যাংক গঠন করতে পারবে। এ ব্রিজ ব্যাংকগুলো সংকটগ্রস্ত ব্যাংকেরকার্যক্রম সচল এবং এর গ্রাহকদের সেবা প্রদান অব্যাহত রাখবে।
প্রস্তাবিত অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ার, সম্পদ ও দায়বদ্ধতা তৃতীয়পক্ষের কাছে স্থানান্তর করতে পারবে। এটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। এছাড়া এঅর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে একটি ব্যাংক রিস্ট্রাকচারিং অ্যান্ড রেজল্যুশন ফান্ড গঠন করা হবে, যা সরকারি অবদান, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক লেভি দ্বারা অর্থায়ন করা হবে।
আশা করা যায়, ব্রিজ ব্যাংকের সফল বাস্তবায়ন আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরবে এবং অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।
লেখকঃ ব্যাংকার। ফেলো কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউনন্টেন্ট (এফসিএমএ)।