Posts

চিন্তা

ভূস্বর্গে রক্তপাত: পেহেলগামের পর্যটক হত্যাকাণ্ড ও অনিশ্চয়তার রাজনীতি

April 23, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

134
View

কাশ্মীর -একটি ভূখণ্ডের নাম নয় কেবল, এটি বহু স্বপ্ন, বেদনা আর সংঘাতের অনবদ্য উপাখ্যান। হিমালয়ের কোল ঘেঁষে বিস্তৃত অপার সৌন্দর্যের এই ভূস্বর্গ আবারও রক্তাক্ত হলো ২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল। ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামে বন্দুকধারীদের বর্বর হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২৬ জন নিরীহ পর্যটক, আহত হয়েছেন আরও ১৭ জন। বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়ার ঢেউ উঠলেও, প্রশ্ন রয়ে যায়—এই প্রতিক্রিয়াগুলো কি নিছক কূটনৈতিক শিষ্টাচার? নাকি এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর ভূরাজনৈতিক কাব্য?

এই হত্যাকাণ্ড কেবল নিষ্ঠুরতা নয়; এটি বহুবিধ স্তরে প্রশ্ন তোলে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, হামলাকারীরা পর্যটকদের ধর্মপরিচয় যাচাই করে গুলি চালিয়েছে। একুশ শতকের প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতার ভেতর এমন আদিম বৈষম্যের দৃশ্য শুধু আতঙ্কজনক নয়, বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নকশার আভাসও দেয়। যেন ইতিহাসের অন্ধকার পৃষ্ঠাগুলি আবারও রক্তমাখা ছায়া ফেলেছে বর্তমানের উপর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ‘লুঙ্গি খুলে ধর্ম পরীক্ষা’ করার ভীতিকর স্মৃতি যেন ফিরে এসেছে পেহেলগামের উপত্যকায়।

এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সৌদি আরব, ইরানসহ বহু দেশ তীব্র নিন্দা জানায় এবং ভারতের পাশে থাকার বার্তা দেয়। ঘটনার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সৌদি সফরে থাকলেও সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ করেন। দুই নেতা একত্রে সন্ত্রাসবাদ রোধে যৌথ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।

অন্যদিকে, পাকিস্তান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করে ঘটনার দায় অস্বীকার করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ এই হামলাকে ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট বলে আখ্যা দেন। তার মতে, ভারতের বিদ্রোহ নেপাল থেকে নাগাল্যান্ড, ছত্তিশগড় পর্যন্ত বিস্তৃত, আর এই সহিংসতা সেই বিস্ফোরণেরই অংশ। যদিও পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের বিরোধী বলেও তিনি দাবি করেন।

বাংলাদেশের সরকার প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নরেন্দ্র মোদীকে শোক জানিয়ে বলেছেন, "Excellency: Please accept my deepest condolences over the loss of life resulting from the terrorist attack that took place in Kashmir's Pahalgam. We strongly condemn this heinous act. Let me reaffirm Bangladesh's resolute stand against terrorism."

প্রশ্ন ওঠে -এত উন্নত প্রযুক্তি, নজরদারি ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার মাঝেও কীভাবে এত বড়সড় হামলা সংঘটিত হলো? কলকাতার পর্যবেক্ষক সায়ক ঘোষ চৌধুরীর কথায়, যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ফেসবুক টাইমলাইনে উদ্ধৃত করেছেন, “কাশ্মীরের জঙ্গিরা সচরাচর পর্যটকদের আক্রমণ করে না, কারণ অর্থনীতি পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। সেনাবাহিনী বরাবরই তাদের লক্ষ্য। এমন হামলার পেছনে কি আদৌ কোনো উচ্চমার্গের পরিকল্পনা কাজ করছে না?”
মিস্টার চৌধুরীর মন্তব্য আরও ইঙ্গিতবহ যখন তিনি প্রশ্ন তোলেন, “আজকের প্রযুক্তির যুগে সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গির প্রবেশ আদৌ সম্ভব? এমন হামলা কি তাহলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আস্থাভাজন মহলের অজান্তে ঘটেছে?”

এ প্রশ্ন শুধু একজন পর্যবেক্ষকের নয়—এটি গোটা কাশ্মীর পরিস্থিতিকে ঘিরে এক গূঢ় ধাঁধার দ্বার খুলে দেয়।

এই বর্বর হামলার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পে। ২০২৩ সালে যেখানে এক কোটি পর্যটক কাশ্মীর সফর করেছিলেন, এই ঘটনার পর উপত্যকার উপর নেমে এসেছে এক ভীতিকর ছায়া। পাহাড়ি সৌন্দর্য, আপেলের বাগান আর হিমধবল নদীগুলোর মাঝে যে স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়াতো, তা আজ রক্তে রঞ্জিত বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে।

কাশ্মীর যেন কখনোই তার ইতিহাস ঝেড়ে ফেলতে পারে না। দেশভাগ, ১৯৪৭-এর দাঙ্গা, ১৯৮৯-এর বিদ্রোহ, ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধ -প্রতিটি ক্ষতই তার শরীরে রক্তাক্ত খোদাই।

পেহেলগামের এই হত্যাকাণ্ড কি তাহলে বালুচিস্তানে ভারতের ভূমিকায় পাকিস্তানের প্রতিশোধ? নাকি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মেরুকরণে এক সুকৌশলে সাজানো ‘ঘরোয়া হামলা’? উত্তর মিলবে না হয়তো, কিন্তু প্রশ্নগুলো নিঃশব্দে বেজে চলবে।

এখন আর কাশ্মীর শুধু ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের কুশীলব নয়; এটি হয়ে উঠেছে এক বিশ্ব সংকটের প্রতীক -যেখানে মানবতা প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণের মুখে। যতদিন মানুষকে তার ধর্ম, জাতি কিংবা পরিচয়ের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে হত্যা করা হবে, ততদিন 'ভূস্বর্গ' শব্দটি শুধু এক অলঙ্কারই হয়ে থাকবে -বাস্তবের মাটিতে রক্তের আঁচড়ে লেপ্টে থাকা এক বিভ্রম।

কাশ্মীর এক নিছক ভৌগোলিক সীমানা নয় -এটি মানুষের স্বপ্ন, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের গাঢ় প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই ভূখণ্ড বারবার বলি হচ্ছে ধর্মান্ধতা, রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন ও কূটনৈতিক চক্রান্তের। মানুষ যদি নিজের পরিচয়ের বাইরে শুধুই মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি না পায়, তবে শান্তি কেবল একরাশ শব্দমাত্র -যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় না গুলির শব্দে, রক্তের গন্ধে।

লেখক: সাংবাদিক
২৩ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login