তৃষা কখনও ভাবে নি যে আজ এমন একটা দিন ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।
যতটা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করছিল সে, কিন্তু মনের মধ্যে সব কিছু উলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। এই দিনটি আসবে, এটা সে কখনও কল্পনা করেনি। মনে মনে অনেক কিছু বলেছিল—এমন কিছু দিন হবে, যখন তার জীবন বদলে যাবে, কিন্তু সে জানত না সেই বদলটা এত কষ্টের হবে। এত বিধ্বংসী।
আজকের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে অস্বাভাবিক, শোকাবহ দিন হতে চলেছিল। অথচ সেই দিনের জন্য কত আশা, কত স্বপ্ন ছিল। বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চেয়েছিল সে, কিন্তু আজ সে বিয়ে করছে এক অজানা জীবনের জন্য—যেখানে নিজের আবেগ, নিজের ইচ্ছাকে অস্বীকার করতে হবে। একদিকে ছিল তার প্রথম ভালোবাসা, আর অন্যদিকে ছিল দায়িত্ব, পরিবারের চাহিদা, আর তার নিজের সম্মান।
গাড়িতে উঠার পর, মিস্টার আমান তৃষার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, তার মুখে টেনশনের ছাপ ছিল। তৃষার চুপ থাকা দেখে, তিনি উদ্বেগের সাথে বললেন, "তৃষা, আপনি ঠিক আছেন তো?"
এইটুকু বলতেই, তৃষার চোখে থাকা জল আর ধরে রাখতে পারলো না। কান্না করতে করতে সে চোখ নামিয়ে ফেললো। তার ভেতরের সব অনুভূতি যেন একসাথে বেরিয়ে আসছিল।
মিস্টার আমান আর দেরি না করে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলো, আর মিস্টার আমান তৃষার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন। তিনি এক মিনিটের জন্য কিছু বললেন না, শুধু গাড়ি থেকে নেমে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন, যেন তৃষা কিছু সময় একা থেকে একটু শান্ত হতে পারে।
এরপর অনেক কান্না করলো তৃষা, যা দেখে মিস্টার আমান একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে মিস্টার আমান ড্রাইভার কে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো.....
তৃষা, চোখে জল রেখে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল, কিছুই বলছিল না। শুধু মনে মনে ভাবছিল, তার জীবনের এই মুহূর্তে কী করবে, কোথায় যাবে, এবং কি হবে ভবিষ্যতে?
ওইদিকে দাদি আমান এর পিএ অন্তরা-কে সঙ্গে নিয়ে আগেই বাসায় পৌঁছে গেলেন। বাড়ির পরিবেশে একটা চাপা উত্তেজনা—সবাই জানে আজ এক নতুন সম্পর্কের শুরু।
দাদি যেন নিজেই পুরো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তিনি বললেন, "অন্তরা, এক কাজ করো, বউয়ের ঘরটা একদম ঝকঝকে করে সাজিয়ে দাও। নতুন বিয়ের বাসর, কোনো ত্রুটি চলবে না!"
অন্তরা সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ অনুযায়ী কাজ শুরু করলো। দাদি নিজ হাতে ফুল বাছাই করলেন, পর্দা ঠিক করলেন, এবং ঘরের কোণে কোণে মৃদু সুগন্ধি ছড়িয়ে দিলেন। ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো এক অপূর্ব রোমান্টিক সৌরভ।
দাদি তখন নিজের মনেই বললেন, "আমি জানি আমার নাতি একটু গম্ভীর, কিন্তু এই মেয়েটার চোখে যে যন্ত্রণা দেখেছি আজ, তার প্রাপ্য আমি যেন তাকে একটু আনন্দ দিতে পারি।"
তিনি তখনো জানেন না, বাসর ঘরের দরজা খুলবে কি না, অথবা তৃষা আদৌ কোনো আবেগ নিয়ে প্রবেশ করবে কি না—তবুও তিনি যেন বিশ্বাস রেখেই রেডি করছেন সবকিছু, এক আশ্চর্য ভরসায়।
কিছুক্ষণ পরেই ধীরে ধীরে গাড়ি এসে থামলো মিস্টার আমান এর বাসার সামনে। দরজা খুলতেই পেছন থেকে গাড়ি থেকে নামলেন তৃষা—চোখেমুখে কোনো রঙ নেই, কেবল নিস্তেজতা।
দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন দাদি। তিনি একদম সামনে এগিয়ে এসে বললেন,
"এসো মা, তোমার জন্যই তো এত আয়োজন।"
মিস্টার আমান কিছু না বলেই তৃষার পাশে দাঁড়ালেন, যেন কোনো কথা ছাড়াই জানিয়ে দিলেন—"তোমার পাশে আমি আছি।"
তৃষা মাথা নিচু করে দাদির পা ছুঁয়ে সালাম করলো। দাদি চোখে জল আটকে রেখে বললেন,
"ভিতরে চলো মা, আজ থেকে এইটাই তোমার ঘর।"
বাড়ির লোকজন একদম চুপ। কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবার চোখ তৃষা আর আমান এর দিকে।
তৃষার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই—না অভিমান, না ভালোবাসা, না অভিযোগ—শুধু এক ধরনের নিঃশেষ অনুভূতি, যা চোখ দিয়ে প্রকাশ পায় না।
মিস্টার আমান ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলো তৃষার দিকে।
তৃষা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো সেই হাতের দিকে, তারপর নিঃশব্দে সেই হাত ধরেই ভেতরে প্রবেশ করলো।
আর সেই মুহূর্তেই দাদি মুচকি হেসে মনে মনে বললেন,
"ভালোবাসা হয়তো সময় নেয়… কিন্তু ঠিক এসে পড়ে একদিন, ঠিক এই ভাবেই।"
চলবে......