Posts

চিন্তা

ধর্মের দেয়াল ভেঙে নজরুলের সম্প্রীতির সেতু

April 24, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

187
View

যতবার সমাজে বিভেদ ও বৈষম্যের দেয়াল সম্প্রীতি ও ঐক্যের মাঝখানে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়, ততবারই আমাদের পরম মিত্র হয়ে ওঠেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহ তাঁর পরিচয়ের প্রথম পরিচায়ক হলেও, সে বিদ্রোহ ছিল বহুমাত্রিক -রাজনৈতিক শাসকের বিরুদ্ধে যেমন, তেমনি ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত গোঁড়ামি, বিভাজন, অন্যায় ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধেও।

নজরুল ছিলেন এমন এক কবি, যিনি ঈমানের মশাল হাতে মানবতার অন্ধকার গলিপথে সাম্যের আলো ছড়াতে চেয়েছেন। তাঁর ধর্মচেতনা কেবল ঈশ্বরপ্রেম নয়, মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ; কেবল আধ্যাত্মিক নয়, ছিল এক নিবিড় সামাজিক দায়বোধে দীপ্ত।

তাঁর বিশ্বাস ছিল -"ধর্মের নামে হানাহানি, মানুষে মানুষে বিভেদ -এসব ঈশ্বরকেও লজ্জায় ফেলে।" তাই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়—
"গাহি সাম্যের গান,
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।"
এই আহ্বান যেন শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত পেরিয়ে এক পরম সাম্যবাদী সমাজের অতুল্য স্বপ্নবুনন।

নজরুলের সাহিত্যচর্চার সময় বাংলা সাহিত্যজগৎ ছিল মূলত হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালিদের দ্বারা প্রভাবিত। সে পরিসরে দাঁড়িয়ে এক মুসলমান কবির পক্ষে কোরআনের আয়াতের পাশাপাশি গীতা, মহাভারতের বচন উদ্ধৃত করা ছিল বিপ্লবী সাহসিকতা। তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে আল্লাহ-রসুলের প্রেম, তেমনি রয়েছে শিব, কালী, কৃষ্ণের প্রতীকী ব্যবহার -যা এক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পবিত্র মিলনের প্রতীক।

নজরুল একদিকে মুসলমান সমাজের অন্ধ আনুগত্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, অপরদিকে হিন্দু সমাজের বর্ণপ্রথা ও সংখ্যালঘু বিদ্বেষের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার শ্লোগান ছিল—
“জাগো, অনশন-রত ব্যথিত ভারত! জাগো!”
তাঁর একমাত্র আকাঙ্ক্ষা -ধর্ম যেন মানুষকে বিভক্ত না করে একত্রিত করে।

‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, ‘মানুষ’, 'জাতের বজ্জাতি' কিংবা ‘সমাধি’ কবিতায় নজরুলের ধর্মচেতনার সঙ্গে সাম্যবাদের সংযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানে জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ নয় -‘মানুষ’ই তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর সাম্যবাদ ছিল মানবিক মূল্যবোধে উদ্ভাসিত—ধর্ম-লিঙ্গ-শ্রেণিনিরপেক্ষ এক সমাজদর্শন।

নজরুলের সাহিত্য কেবল কবিতা বা গান নয়, এক জীবন্ত ধর্মতত্ত্ব -যেখানে উপাসনা মানে প্রতিবাদ, প্রার্থনা মানে মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষা, আর ঈশ্বর হলেন সেই মানবিক চেতনার প্রতীক, যিনি বন্দী নন কোনো মসজিদ, মন্দির বা গির্জায় -আছেন শ্রমজীবীর ঘামে, শোষিতের চোখের জলে, প্রেমিকার প্রতীক্ষায়, কিংবা বিদ্রোহীর জাগরণে।

১৯২৬ সালের ২ এপ্রিল, কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষিতে নজরুল ‘গণবাণী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। সেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে বলেন -বাইরের লেজ কাটা যায়, কিন্তু ভেতরের লেজ কাটা যায় না। দৃশ্যমান শত্রুকে পরাস্ত করা যায়, কিন্তু অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা কঠিন। নজরুল লিখেছেন—
“ন্যাজ যাদেরই গজায় -তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক -তারাই হয়ে ওঠে পশু। মানুষ আজ পশুতে পরিণত হয়েছে, চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে।”
এই উপমা আজও যেন উপমহাদেশীয় ধর্মীয় উত্তেজনার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।

নিজের সমাজ নিয়ে কবি এক পত্রে ইব্রাহীম খাঁ-কে লেখেন -“বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া, আর শিক্ষিতরা ঈর্ষাপরায়ণ। ...মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে আমার কবিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে জড়িয়ে। আমি মুসলমান -তবে আমার কবিতা সকল জাতি, সকল কালের।”

নজরুলের ধর্মচেতনা আমাদের শেখায় -ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে শেখালে তবেই তা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। সাম্য কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, তা হতে পারে কবিতার মতো কোমল এক আশ্বাস -যে আশ্বাসে সমাজ বদলায়, মন বদলায়, মানুষ বদলায়।

তাই তিনি ঘোষণা দেন—
"গাহি সাম্যের গান,
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।"

তিনি প্রশ্ন তোলেন—
"কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত-পুথি-কঙ্কালে?
হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!"

এবং সর্বোপরি তিনি বিশ্বাস করেন—
"এই হৃদয়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন।
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়—
এইখানে বসে ঈসা-মূসা পেল সত্যের পরিচয়!"

নজরুল দর্শনের হাজার কথার মাঝে এক 'সাম্যবাদী'ই যেন ধর্মের হিংস হুতাশনে পরম প্রীতির শান্তির সুবাতাস-
"এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।"

লেখক: সাংবাদিক
২৪ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login