Posts

উপন্যাস

তোমার জন্য....(পর্ব -৪৩)

April 24, 2025

Boros Marika

45
View

তৃষা ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো। মিস্টার আমান এর বাড়িটা যেন কোনো রাজপ্রাসাদ—উঁচু ছাদ, চারপাশে প্রাচীন কাঠের খোদাই করা আসবাব, দেয়ালে ঝুলছে পুরোনো রাজকীয় শিল্পকর্ম, ছাদ থেকে ঝুলে আছে বড়সড় ঝাড়বাতি। প্রতিটি কোণ যেন একেকটা গল্প বলে।

শোপিসগুলো বিলুপ্ত শিল্পকর্ম—কোনোটা জাপানি কাঠের পুতুল, কোনোটা পারস্যের মিনাকারি, আবার কোথাও রাখা আছে পুরোনো বাংলার কাঁসার তৈজসপত্র। তবুও এই সবের মাঝে ছিল আধুনিকতার স্পর্শ—নরম আলো, মার্বেল মেঝে, আর নিঃশব্দ এয়ার ফ্রেশনারের সুবাসে মোড়া প্রতিটি ঘর।

কিন্তু তৃষার চোখে এই সৌন্দর্যের কোনো প্রতিচ্ছবি ধরা পড়লো না। তার ভেতরটা এখনো ভারী, যেন কোনো এক অজানা অভিমানে আটকে আছে নিঃশ্বাস। চোখ চলে যাচ্ছিলো ছাদের দিকে, দেয়ালের দিকে, জানালার পর্দার দিকে, কিন্তু মন ছিল কোথাও না, একেবারে শূন্য।

মিস্টার আমান তৃষার পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলো—তৃষা কিছু বলছে না, কিছু অনুভবও করছে না যেন।
সে শুধু একবার বলল,
"এই বাড়ি তোমার মতো কাউকেই খুঁজছিল এতদিন…"
তৃষা কোনো উত্তর দিলো না। সে শুধু একটু মাথা নিচু করে নিজের চোখের জলটা আড়াল করার চেষ্টা করলো।

আর তখনই দাদি এসে বললেন,
"চলো মা, তোমার ঘর রেডি। আজ রাতটা একটু কষ্টের হতেই পারে, কিন্তু কাল থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।"

তৃষা শুধু মাথা নেড়ে সাড়া দিলো।
আজ বাড়ির রাজপ্রাসাদে যেন এক রাণী এসেছেন—কিন্তু রাণীর মুকুটে ছিল না আনন্দের ঝিলিক, ছিল কেবল নিঃশব্দ অশ্রু।

তৃষা ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করলো। পেছনে মিস্টার আমান, চুপচাপ তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

রুমে পা রাখতেই এক অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়লো চোখে। পুরো বেডরুমটা যেন কোনো রূপকথার রাজ্য। সাদা আর লেভেন্ডার রঙের এক শান্ত, কোমল ছোঁয়া—দেয়ালের পর্দা, বেডশিট, কুশন, এমনকি আলোর আলোও যেন ছিল সেই রঙে ছায়াপথে মোড়া।

ফ্লোরে বিছানো ফুলের পাপড়িগুলো ছিলো একদম তাজা। গোলাপ, জুঁই, ল্যাভেন্ডার—সব মিলে এক মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে ছিলো ঘরে। বিছানার ঠিক মাঝখানে রাখা ছিলো একটা ছোট্ট সাদা বাক্স, পাশে একটা হাতের লেখা চিঠি, হয়তো দাদির সাজানো কিছু ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।

তৃষা চোখ মেলে চারপাশ দেখলো, একবারও কিছু বললো না। এই সাজসজ্জা হয়তো কোনো কল্পনায় ছিল, কিন্তু বাস্তবে এতটা নিখুঁত আর রাজকীয় হয়ে উঠবে, তা ভাবেনি কখনো।

মিস্টার আমান আস্তে করে বললো,
"এই ঘরটা তোমার জন্যই সাজানো হয়েছে, তৃষা। আজকের রাতটা কষ্টের হোক বা নীরবতার, আমি চাই তুমি এখানে নিজের মতো থাকতে পারো। আমি কিছু জোর করবো না—তোমার মন চাইলে আমরা কথা বলবো। না চাইলে শুধু চুপচাপ বসে থাকবো দু’জন।"

তৃষা কোনো উত্তর দিলো না, শুধু একটু বসে পড়লো বেডের পাশে রাখা সোফায়। ঘরটা সুন্দর, কিন্তু তার ভিতরের দুঃখ সে কোনো ফুলে ঢেকে রাখতে পারছিলো না।
তবুও মিস্টার আমান তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো—একটা নীরবতা, একটা অচেনা বন্ধন, একটা অজানা রাত… শুরু হলো।

মিস্টার আমান ধীরে ধীরে তৃষার দিকে এগিয়ে এসে নিচু গলায় বললো—

"আজ আমাদের এই বিয়েটা… খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত। এটা নতুন করে বলার কিছু না, তবুও বলছি। আমি জানি না এই সম্পর্ক কতটা মজবুত হবে, কতটা টিকবে… হয়তো চিরদিনের জন্য, হয়তো না। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে চাই—আমরা দুজনেই সময় পাবো সবকিছু মেনে নেওয়ার জন্য, এবং আমি চাই সেই সময়টুকু তুমি তোমার মতো করে নাও।"

তৃষা চুপচাপ শুনছিলো। মিস্টার আমান একটু থেমে আবার বললো—

"আমি তোমার জীবনে জোর করে আসিনি, পরিস্থিতি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি তোমার সম্মান, স্বাধীনতা—সবকিছুর মূল্য দেবো। আমি চাই না তুমি নিজেকে বন্দী মনে করো। আজ থেকে আমরা যদি একসাথে চলি, তাহলে সেটা হবে সম্মানের সাথে, জোরের সাথে নয়।"

এই কথাগুলোতে কোনো প্রলোভন ছিল না, ছিল না কোনো দাবি—শুধু একরাশ দায়িত্ববোধ, এক অদ্ভুত সম্মানবোধ।

তৃষা কিছু বললো না, চোখ নামিয়ে রাখলো। কিন্তু তার ঠোঁটের কোণায় একটুকু কাঁপুনি দেখা দিলো—মনের ভেতরের ঝড়টা হয়তো একটু ধীরে হতে শুরু করেছে।
মিস্টার আমান একটু থেমে নরম গলায় বললো—

"আর হ্যাঁ… আমি তোমাকে একটা কথা ওয়াদা করেছিলাম বিয়ের আগে—সেটা আমি  ভুলি নাই। তুমি যখনই চাইবে, আমি তখনই প্রস্তুত আছি। জোর করে কিছু চাইবো না… শুধু তোমার ইচ্ছার সম্মান রাখবো তাতে যা হয়ে যাক"

তৃষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে জল জমেছে, কিন্তু সে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে। এইসব কথাগুলো যেনো তার ভিতরের কোনো জমাট বাঁধা বরফ একটু একটু করে গলিয়ে দিচ্ছে।
তার দৃষ্টি তখন ফুলে সাজানো বিছানার দিকে নয়, বরং সেই মানুষটার দিকে—যে হুট করে তার জীবনের একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছে।

তৃষা কিছু বললো না, শুধু নিঃশব্দে বসে পড়লো রুমের এক কোণে রাখা এক সোফায়। যেনো সে একটু সময় নিতে চাইছে, একটু নিশ্বাস নিতে।

চলবে......

Comments

    Please login to post comment. Login