"…বক্তৃতা-বক্তব্যে সংযম প্রদর্শন করলেও তাদের অন্যতম প্রধান একটি উদ্দেশ্য হলো ঐতিহাসিক বয়ান পুনরায় লেখা, যেন তাদের ১৯৭১ সালের বীর না হলেও অন্তত ভুক্তভোগী হিসেবে দেখানো হয়…"
-রেহমান সোবহান, প্রথম আলো, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
রেহমান সোবহান বাংলাদেশের রাজনীতির প্রাজ্ঞ পর্যবেক্ষক। প্রথম আলোতে তাঁর সাম্প্রতিক দু-পর্বের রাজনৈতিক পর্যালোচনায় তিনি যে চিত্র এঁকেছেন, তা নিছক সমসাময়িক বিশ্লেষণ নয় -এটি ভবিষ্যতের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। যেখানে ইতিহাস, রাজনীতি, এবং আদর্শিক মেরুকরণ আবারও এক জটিল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে -এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রমাণিত সত্য। অথচ এখন তারা ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রক্রিয়ায় নিজেদের ‘ভুল বোঝা দেশপ্রেমিক’ বা ‘রাজনৈতিক বিভ্রান্তির শিকার’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি নৈতিক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে যারা অস্ত্র হাতে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, যারা ধর্ষণ-হত্যা-লুণ্ঠনের মাধ্যমে পাক হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, তারা কোনোভাবেই ‘ভুক্তভোগী’ নয়। অথচ আজ তাদের উত্তরসূরিরা, এমনকি জামায়াতে ইসলামীর মত দলগুলোও, একটি ‘বিকল্প বয়ান’ দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে—যেখানে বাংলাদেশ নাকি ভুল শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়েছিল!
এই 'রিভিশনিস্ট ন্যারেটিভ'-এর মাধ্যমে তাদের চাওয়া ইতিহাসের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত নয়, বরং সহানুভূতির পাতায় স্থান পাওয়া। তারা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী না দেখিয়ে, একটি 'রাজনৈতিক বিভ্রান্তি'র শিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই বিকৃত ইতিহাস নির্মাণ নিছক মতবাদের অনুশীলন নয় -এটি একধরনের কৌশলগত পুনর্বাসন, যা ভবিষ্যতের নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘যোগ্যতা’ অর্জনের প্রস্তুতি। রেহমান সোবহান যথার্থই ইঙ্গিত করেছেন, এই বিকৃত বয়ানের উদ্দেশ্য তাদের রাজনৈতিক পুনর্জন্ম ও বৈধতা আদায়। তারা দাবি করছে, বাংলাদেশ নাকি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে 'ভুল শত্রুর বিরুদ্ধে' যুদ্ধ করেছিল -যা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে অস্বীকার করার শামিল।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো -নতুন রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষ করে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ গঠনে যুক্ত কিছু ছাত্রনেতা, জামায়াতঘেঁষা এই বিকল্প বয়ানকে আত্মস্থ করছে। সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি, দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণার প্রস্তাব -এসবই ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ের সন্ধান, যা হয়তো আকর্ষণীয় শোনায়, কিন্তু আদতে তা জাতির ভিত্তির উপর আঘাত।
রেহমান সোবহান পরামর্শ দিয়েছেন, এনসিপির উচিত হবে ইতিহাসের পুরোনো বিতর্কে না জড়িয়ে নিজেদের ভবিষ্যতের একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তারা উল্টো পথে হাঁটছে। এটাই ‘বিপজ্জনক গ্রহণযোগ্যতা’র সূচনা -যেখানে জামায়াতপন্থী বয়ানকে তথাকথিত ‘আধুনিক বয়ান’ হিসেবে গ্রহণ করে রাজনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা নিছক ভাঙচুর নয় -এটি ইতিহাস মুছে ফেলার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা। রেহমান সোবহান একে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছেন। এই ধ্বংসের মাধ্যমে ইতিহাসকে পুনর্লিখনের যে অভিসন্ধি রয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না গড়লে তা সমাজে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়াবে এবং ঐতিহাসিক নৈতিকতারও অবসান ঘটাবে।
আমরা কি ইতিহাসের পাহারাদার হবো, নাকি দাস? আজ আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো -আমরা কি ইতিহাসের বিকৃত ব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবো? নাকি সুবিধাবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করে ইতিহাসকে কুয়াশায় ঢেকে ফেলবো? জামায়াত এবং তাদের বয়ান শুধু একটি দলের নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির পুনরুত্থান -যা ধর্মীয় মোড়কে জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রকে প্রতিস্থাপন করতে চায়।
এই সময়ে প্রয়োজন ইতিহাসের সত্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। ইতিহাস কেবল অতীত নয় -এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক। আর সেই ইতিহাসকে মুছে ফেলার প্রয়াস মানে জাতির আত্মাকে বিলীন করার অপচেষ্টা। ইতিহাস কোনো একক দলের সম্পত্তি নয়, এটি জনগণের আত্মার দলিল। আর সেই দলিল রক্ষায়, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ হওয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক: সাংবাদিক
২৪ এপ্রিল ২০২৫