প্রায় ত্রিশ বছর পর হঠাৎ একদিন হোটেলের লবিতে দেখা হয়ে গেলো আমার এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। শৈশবের সেই মৃদুভাষী, ভদ্র স্বভাবের, শান্ত ছেলেটি—যে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতো—আজো যেন সেই আগের মতোই রয়ে গেছে। চেহারায় সেই বিনয়ের ছাপ, পরনে সাধারণ পোশাক, চাল চলনে নেই কোনো বাহুল্য।
কুশল বিনিময়ের পর আমি বললাম, "চল, তোকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দেই।"
আসলে গাড়িতে তুলে নেওয়ার পেছনে একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিলো— আর তা হলো আমার নতুন কেনা দামী মার্সিডিজ গাড়িটা ওকে দেখানো!
আমার নিজের মনে হচ্ছিলো, বন্ধু দেখুক আমি আজ কতো সফল, কতো বড়লোক হয়েছি! কিন্তু সে বিনয়ের সাথে জানালো, “না, থাক, আমি না হয় ভাড়া করা গাড়িতে করেই চলে যাবো।”
পার্কিং লটে দুজনে পাশাপাশি হেঁটে এলাম। বন্ধুর ভাড়া করা গাড়িটা একেবারেই সাধারণ। মনটা একটু খচখচ করলো, ভাবলাম, ও এখনও এমন সাধারণ গাড়িতে চলে?
সপ্তাহখানেক পরে আমার আলিশান বাসায় ওকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানালাম। ও পরিবারসহ এলো। তার স্ত্রী, সন্তান সবাই এতোই নম্র আর মার্জিত যে দেখে মনটা ভরে গেলো। সাজ-পোশাকে কোন আড়ম্বর নেই, কিন্তু মনে একটা প্রশান্তি, একটা শান্ত সৌন্দর্য তাদের চোখে মুখে।
সেই ডিনারে আমি কৌশলে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছিলাম যে—আমার অভিজাত জীবন, দামি বাড়ি, লাক্সারিয়াস আসবাবপত্র, অফিসের খরচে বিদেশ ভ্রমণ, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক, কতো কতো ধনী লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ—এসব যেন ও দেখেই মুগ্ধ হয়।
সত্যি কথা বলতে, আমি যেনো আমার আভিজাত্য ওর চোখে ঢুকিয়ে দিতে চাইছিলাম। একটার পর একটা ছবি দেখাচ্ছিলাম, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বিজনেস প্রসঙ্গে কথা তুলেছিলাম।
কিন্তু ও যেন এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা উৎসাহী না। বরং ওর মুখে তখন অন্য আলো—শৈশবের স্কুল, পুরোনো বন্ধু, প্রিয় স্যারদের কথা... কতদিন কারও কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না, কতজন এখন আর হয়তো বেঁচে নেই—এসব মনে করে ওর চোখে একটুখানি জলও দেখা গেলো।
আমার স্ত্রী তখন পাশ থেকে একটু বিরক্ত হয়ে বললো, “শুধু পুরোনো স্মৃতি আর নীতিকথা মনে করে থাকলে জীবনে আর এগোনো যায় না!”
ওর এ কথা শুনে আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।
ডিনারের পরে ওরা চলে গেলো। আমি ভাবলাম, এবার নিশ্চয় ও বুঝতে পারলো, কে কতো দূর এগিয়েছে!
কয়েক সপ্তাহ পর ফোন এলো বন্ধুর কাছ থেকে।
বললো, “দুপুরে একটু সময় করে, আমাদের বাড়িতে খেতে এসো।”
আমি ওকে অনেক ভালোবাসি, তাই স্ত্রীকে জোর করে রাজি করিয়ে নিয়ে গেলাম ওর বাসায়।
বাড়িতে গিয়ে দেখি, খুব গোছানো, পরিপাটি কিন্তু একদম সাধারণ। দামি আসবাব নেই, ঝকমকে কিছু নেই, তবু কী যে শান্ত আর আপন একটা পরিবেশ! যেন একটা মমতার ঘ্রাণ চারপাশে ভাসছে।
টেবিলের উপর চোখ পড়তেই দেখি—আমার কোম্পানির পাঠানো একটা সুন্দর গিফট বক্স!
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “এই কোম্পানিতে তো আমি চাকরি করি! তা তুমি এটা কোথায় পেলে?”
সে হেসে বললো, “ডেভিড পাঠিয়েছে।”
আমি থমকে গিয়ে বললাম, “কোন ডেভিড? ডেভিড থমসন?”
সে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, সেই ডেভিড থমসন। ও আমার পুরনো বন্ধু। আমরা বহু দিন ধরেই একসাথে ব্যবসা করি।”
আমি যেন অবিশ্বাস করছিলাম! তাহলে এই মানুষটাই আমাদের কোম্পানির সত্তর পারসেন্ট সম্পত্তির মালিক! যার নামে আমরা সম্মানে মাথা নিচু করি, সেই ডেভিড থমসনের বন্ধু—এই আমার সেই ছোটোবেলার সাধারণ বন্ধু!
আমি যেনো মুহূর্তেই নিজের ভেতরে খুব ছোটো হয়ে গেলাম। যে মানুষটিকে আমি আমার দামী জিনিসপত্র দেখিয়ে মুগ্ধ করতে চেয়েছিলাম, সে তো নিজেই আমার চাকরিদাতার বন্ধু। এমনকি কোম্পানির বেশিরভাগ মালিকানাও তার!
আমার অহংকার, দম্ভ, গর্ব—সব যেন এক নিমেষেই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেলো।
গাড়িতে ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকালাম।
দেখলাম, তিনিও চুপচাপ। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু মনের মধ্যে চলছে অনেক কিছুর ঝড়।
হঠাৎ মনে পড়লো, আমাদের স্কুলের সেই প্রিয় স্যার বলতেন, “যে নদী যতো গভীর, তার বয়ে চলার শব্দো ততোই কম।”
আজ সত্যিই বুঝলাম কথাটার মানে। যাদের হৃদয়, মানসিকতা আর আত্মবিশ্বাস গভীর—তারা কখনো বাহারি কথা বলে না, দামি জিনিস দেখিয়ে বড়ো হওয়ার অপচেষ্টা করে না। তারা নীরবেই বয়ে চলে, কিন্তু তাদের গভীরতাই সত্যিকারের বড়ত্বো।
আজ আমি একটা কারুকার্য খচিত ঘটের মধ্যে বন্দি জল নয়, বরং গভীর নদীর নিঃশব্দে বয়ে চলা দেখেই বাড়ি ফিরলাম।