ঘর জুড়ে থমথমে নিস্তব্ধতা।
কোনো কথা নেই, কোনো শব্দ নেই — শুধু দু'জন দুই পাশে।
তৃষা বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে, আমান সোফায়।
ঘুম যেন আজ দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে।
কেবল অন্ধকারের মধ্যে হালকা হালকা নিশ্বাসের শব্দ।
তৃষা বিছানায় চুপচাপ শুয়ে, একফোঁটা একফোঁটা করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার চোখ বেয়ে।
কোনো কান্নার শব্দ নেই, কোনো অভিযোগ নেই —
শুধু নিঃশব্দে বুকে জমে থাকা হাজারো যন্ত্রণার প্রকাশ সেই নীরব কান্নায়।
আমানও ছাদটার দিকে তাকিয়ে ছিল স্থির দৃষ্টিতে।
মনের ভেতর চলছিল অবর্ণনীয় ঝড়, কিন্তু মুখে এক ফোঁটা শব্দও নেই।
ঘরটা যেন দুইটা ভাঙা হৃদয়ের বোবা সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওদিকে আরিয়ানের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। চোখের নিচে কালি, গালের উপর ছায়া পড়ে গেছে অল্প সময়ে। ঠিক তখনই তার বাবা-মা এসে রাগে-দুঃখে প্রশ্ন করলেন,
— "বাবা, বিয়ের সময় তুই কোথায় ছিলি? এটা কি ঠিক হয়েছে? এভাবে তুই তৃষাকে হারিয়ে ফেললি?"
আরিয়ান সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু আর পারলো না।
চোখ ভিজে উঠলো, গলা কেঁপে উঠলো।
সে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলো,
— "এই কথাটাই তো বলার জন্য বসে আছি! কেউ তো শুনলো না... আমি ছিলাম বর! আমি তৃষাকে ভালোবাসি! আজ আমাদের বিয়ে ছিলো! যদি আমি ঠিক সময়ে না থাকতাম, তাহলে তোমাদের, আমার বাবা-মা হিসেবে, ভাবা উচিত ছিল— নিশ্চয়ই আমার কিছু হয়েছে!"
আরিয়ানের কণ্ঠে গভীর কষ্ট আর অভিমানের মিশ্রণ ছিল।
তার বাবা-মা থমকে গেলেন।
আরিয়ান দুহাতে মাথা চেপে ধরে নিচু গলায় বললো,
— "কিন্তু তোমরা কিছু ভাবলে না... ভাবলে শুধু লোকলজ্জা আর সমাজের কথা..."
তার ভেতর থেকে যেন সবকিছু ভেঙে ভেঙে পড়ছিল।
পৃথিবীর সমস্ত অভিমান যেন ওই মুহূর্তে তার চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়লো।
তখন আরিয়ানের বাবা হতাশ গলায় বললেন,
— "আমরা ভেবে কি করতে পারতাম, বাবা? ওই মেয়েটাকে তো সমাজ কোনো ছাড় দিচ্ছিল না। কত বাজে কথা, কত অপবাদ... মানুষ যা ইচ্ছা তাই বলতে শুরু করেছিল। তৃষা বেচারি অনেক কষ্টে ছিল, একেবারে ভেঙে পড়েছিল।"
তার চোখেও অভাবিত কষ্টের ছায়া পড়লো। একটু থেমে আবার বললেন,
— "তৃষার পরিবারও তখন ভীষণ বিপদে ছিল। ওদের অবস্থা দেখে কারও কষ্ট না হয়ে পারত না। আর তোর বসের দাদিমা... উনি নিজে এসে বললেন, উনি তৃষাকে নিজের বউমা বানাতে চান।"
আরিয়ান স্তব্ধ হয়ে শুনছিলো। বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছিলো।
তার বাবা আবার বললেন,
— "এরপরও সবাই রাত বারোটা পর্যন্ত তোর জন্য অপেক্ষা করেছে, বাবা। মনে কর, কতক্ষণ? তোর জন্য, শুধুমাত্র তোর জন্য। কিন্তু তুই এলি না। আমরা আর কী করতে পারতাম তখন?"
আরিয়ান কিছু বলার শক্তি হারিয়ে ফেললো। মনে হলো পুরো দুনিয়া তার বুকের ওপর ভেঙে পড়ছে।
চোখের কোনা দিয়ে চুপচাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো...
তৃষাকে হারিয়ে ফেলার ব্যথা যেন পুরো শরীর ছেঁড়ে বেরিয়ে আসছিলো।
তার বাবার মুখ থেকে শেষ কথা বের হলো,
— "মেনে নে, তোর ভাগ্যে তৃষা নেই, বাবা।"
এই কথাটা যেন বজ্রাঘাতের মতো আরিয়ানের মাথায় বাজলো।
আর কিছু শুনতে পারলো না। না কোনো অভিযোগ, না কোনো ব্যাখ্যা।
শুধু দমবন্ধ করা যন্ত্রণায় উঠে দাঁড়ালো।
চোখেমুখে ক্রোধ আর ভেতরে হাহাকার নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো আরিয়ান।
পেছনে মায়ের কান্না, বাবার ডাকে আর নিজের ভেঙে পড়া আত্মাকে ফেলে রেখে সোজা রাস্তায় নেমে পড়লো।
পায়ের দাপটে ধুলা উড়ছিলো, আর বুকের ভেতর কেবল একটা আওয়াজ...
— "তৃষা... তৃষা..."
কিছু না ভেবেই পৌঁছে গেলো শহরের এক নির্জন বারে।
ভেতরটা অন্ধকার, আলো আধারিতে কেবল নিরবতা আর বিষণ্নতা।
আরিয়ান এক নিঃশ্বাসে একের পর এক গ্লাসের পর গ্লাস মদ খেতে শুরু করলো।
হাত কাঁপছিলো, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো, তবুও সে থামছিলো না।
প্রতিটা চুমুকের সাথে মনে পড়ছিলো তৃষার হাসি, তৃষার চোখের জল, তাদের প্রতিটি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত।
তার কণ্ঠ ফেটে আসছিলো, বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাইরে সে ঠান্ডা, নিশ্চুপ।
বারের কোণায় বসে আরিয়ান নিজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলো...
কেউ বুঝতে পারছিলো না, এই ছেলেটার ভেতর একটা জীবন ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে।
চলবে………….