একদিন ছিল, যখন মুসলিম জাতি বিশ্বজয় করত কলমের দীপ্তিতে। গ্রন্থের পৃষ্ঠায় আঁকা হতো মানবতার স্বপ্ন, আর গবেষণাগারে নির্ঘোষ উঠত জ্ঞানের নব নব সূর্যোদয়ের। আর আজ?
আজকের উত্তরসূরিরা ফেসবুকে 'জয়বাংলা' স্লোগান দিয়ে পাঠাগার তছনছ করে, বই লুট করে, আর আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার অভয়ারণ্য পাঠাগারে সদলবলে হামলা চালিয়ে প্রায় ৪০০ বই লুট করে নিয়ে গেলো একদল কথিত ‘বিশুদ্ধতার যোদ্ধা’। অপরাধ?
ওখানে ছিল হুমায়ুন আজাদ, জাফর ইকবাল, হুমায়ুন আহমেদ এমনকি নজরুল-রবীন্দ্রনাথের বই। ‘নাস্তিকতার’ অভিযোগে বইগুলো বন্দি করা হলো ইউএনও কার্যালয়ে। গোটা ঘটনায় জাতি আবারও প্রমাণ করলো -পূর্বপুরুষদের গৌরবকে বিস্মৃত হয়ে আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। বইয়ের আলোকে ভয় পাই, ভিন্নমতকে সহ্য করি না।
ভেবে দেখুন, আজ যদি আল-জাহিজ (৮০০-৮৬৮ খ্রি.) এই বাংলাদেশে জন্মাতেন, তিনি বোধহয় জীববিকাশ (Evolution) নিয়ে লেখার অপরাধে ফতোয়াবাজদের হাত থেকে রেহাই পেতেন না! কিংবা ইবনে রুশদের (১১২৬-১১৯৮) মতো দার্শনিকরা এখন জন্মালে, তাদের গ্রন্থাগার আগুন দিয়ে ভস্ম করে দেওয়া হতো! অথচ এই ইবনে রুশদই ছিলেন এমন এক চিন্তাবিদ, যিনি গ্রিক দর্শনকে ইসলামি বিশ্বে পুনর্জাগরণ ঘটান এবং যার চিন্তাধারা ইউরোপের রেনেসাঁর ভিত্তি রচনা করে।
আজ যারা বই লুট করে ‘বিশুদ্ধতা’ প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা ভুলে গেছেন, ইসলামের স্বর্ণযুগের মুসলিমরা ছিল বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঠক ও গবেষক। বাগদাদের ‘বাইতুল হিকমা’ (House of Wisdom) ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্ঞানকেন্দ্র—যেখানে হিন্দু, গ্রিক, পারসি, খ্রিস্টান, ইহুদি—সবার জ্ঞানকে সমানভাবে অনুবাদ ও সংরক্ষণ করা হতো।
সেসময়ও গোঁড়া ধার্মিকরা চিন্তার গভীরতাকে ভয় পেত। কিন্তু শেষ বিচারে জিতে যেত চিন্তাবিদরাই। বাগদাদের রাস্তায় তখন বই বিক্রি হতো চাল-ডালের মতো, আর আজ এখানে পাঠাগার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ফেলনা ধূলো ময়লার মতো। কী মর্মান্তিক!
আজকের 'খেলাফত মজলিসের' নেতারা যদি সেই সময় বেঁচে থাকতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আল জাবেরের (Father of Chemistry) রসায়ন গবেষণাগার গুঁড়িয়ে দিতেন, কিংবা আল-বেরুনির (৯৭৩-১০৪৮) ভারত-বিজ্ঞান গবেষণাকে 'ভিনদেশি অপসংস্কৃতি' বলে ধ্বংস করতেন।
বিশ্ব যখন ন্যানোপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় অগ্রসর, তখন এদেশের কিছু যুবকের সংগ্রাম -কয়েকটি বই ছিনিয়ে নেওয়া, যেন নাস্তিকতার মূলোৎপাটন হলো!
তারা বোঝে না, বই পোড়ালে চিন্তা পোড়ে না; বই লুট করলে যুক্তি থেমে থাকে না; বরং বোধের প্রদীপ নিভিয়ে দিলে সভ্যতাই অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, "একটি বই, একটি কলম, একটি শিশু, এবং একজন শিক্ষকই পারে বিশ্ব পরিবর্তন করতে।" কিন্তু যদি বই-কলম কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে শুধু অন্ধকারই ঘনীভূত হয়।
শেষ কথা -পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আহ্বান ছিল "ইকরা" -অর্থাৎ পড়ো। এখন যারা ‘পড়ো’র পরিবর্তে ‘পোড়াও’কে বেছে নিয়েছে, তারা আসলে নিজেরাই অজ্ঞানতার কারাগারে বন্দি। এরা ইবনে সিনার উত্তরসূরি নয়, বরং জ্ঞানের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধরত এক করুণ প্রজন্ম।
রেফারেন্স:
• Will Durant, The Story of Civilization, Volume IV: "The Age of Faith", 1950.
• Hugh Kennedy, When Baghdad Ruled the Muslim World: The Rise and Fall of Islam's Greatest Dynasty, 2005.
• Malala Yousafzai, Nobel Peace Prize Speech, 2014.
লেখক: সাংবাদিক
২৬ এপ্রিল ২০২৫