প্রথম পর্ব
চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ। শহরের বাতাসে যেন গ্রীষ্মের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল রূপা। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। হাতে একটা ভারী ব্যাগ, মাথায় কাজের চাপ—সব মিলিয়ে মনটাও একটু খিটখিটে হয়ে উঠেছিল।
শহরের ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে একটা ছোট্ট কফি শপের সামনে দাঁড়িয়ে সে একটু জিরিয়ে নিল। এই কফি শপটা তার খুব প্রিয়—"কফি ক্যানভাস"। এখানকার এককাপ ক্যাপুচিনো যেন তার ক্লান্তিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
ভেতরে ঢুকতেই একটা হালকা সুর ভেসে আসলো—একজন গিটার বাজাচ্ছে কোণার টেবিলে বসে। রূপা একটু অবাক হলো। এই কফি শপে মাঝে মাঝে লাইভ মিউজিক হয় ঠিকই, কিন্তু আজকের এই গিটার সুর ছিল কিছুটা ভিন্ন। মন ছুঁয়ে যাওয়া।
একটা খালি টেবিলে বসে সে কফি অর্ডার দিলো। চোখ চলে গেল সেই গিটারওয়ালার দিকে। ছেলেটা বেশ মনোযোগ দিয়ে একটা মেলোডি বাজাচ্ছিল, যেন নিজের ভেতরের অনুভূতি বের করে আনছে সুরের মাধ্যমে।
ঠিক তখনই বিপত্তি।
ওয়েটার কফি নিয়ে আসছিল। এক মুহূর্তের অসাবধানতায় কফির কাপটা ঠিক রূপার টেবিলের কিনারায় এসে পড়লো। চমকে উঠে দাঁড়ানোর সময় রূপার হাতের ব্যাগটা পড়ে গেল মাটিতে, আর ব্যাগের সব কিছু ছড়িয়ে পড়লো।
"ওহ স্যরি স্যরি!" — ছেলেটা গিটার রেখে ছুটে এল সাহায্য করতে।
সে-ই ছেলেটা, যিনি এতক্ষণ গিটার বাজাচ্ছিল।
"আপনার সব ফাইল ভিজে গেছে মনে হচ্ছে!" — হালকা অস্বস্তি নিয়ে বললো ছেলেটা।
রূপা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, "ধন্যবাদ, আমি সামলে নিতে পারবো।"
কিন্তু ছেলেটা সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। সে নিচু হয়ে ব্যাগের ছড়িয়ে পড়া জিনিসগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো। তার মুখে অদ্ভুত এক শান্তি, বিনয়ে ভরা।
রূপা চুপ করে তাকিয়ে থাকলো।
মনের ভেতর যেন কোথাও একটু ধাক্কা লাগলো। এই ছেলেটির হাসিতে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আছে।
সব গুছিয়ে দিয়ে ছেলেটা বললো, "আমি অর্ণব। আপনাকে কফি অফার করতে পারি? যেহেতু সমস্যাটা আমারই করা।"
রূপা একটু মুচকি হাসলো। বিরক্তি কেমন মিলিয়ে গেল।
"রূপা," সে নিজেও পরিচয় দিল, "আর হ্যাঁ, একটা কফি অফার নিতে পারি।"
দুজনের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধ তৈরি হলো।
কফির মগের ধোঁয়া আর আলতো গিটার সুরের ভেতর দিয়ে শুরু হলো এক নতুন পরিচয়ের গল্প।
সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো।
রূপা আর অর্ণব হাসতে হাসতে কথা বলছিলো—প্রথমে অফিসের গল্প, তারপর পছন্দের গান, পছন্দের বই। কিছু অদ্ভুত মিল তাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে আসছিল।
হয়তো তারা দুজনেই জানতো না—এই সামান্য একটি সন্ধ্যা তাদের জীবনের রং বদলে দেবে।
হয়তো সেদিন কফির ভেজা দাগের মতই তারা দুজন পরস্পরের জীবনে মিশে যাবে—চিরদিনের জন্য।