Posts

চিন্তা

চিরনির্বাসনে কবি দাউদ হায়দার

April 27, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

322
View

সত্তর দশকের গোড়ার দিকে দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কবি দাউদ হায়দার। ওই পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয় তাঁর বহুল আলোচিত কবিতা, কালো সূর্যের কালো জোৎস্নায় কালো বন্যায়। কবিতার কিছু অংশ—
জীবে প্রেম? মানুষে মানুষে ভালবাসা? প্রেম অশ্রু আমার ভোঁতা।
অ্যারিস্টটল, প্লেটো, আমার চৈতন্যে; তাদের চৈতন্যই আমার বিশ্বাস।
নীটশের কথাই ঠিক; ঈশ্বর মরেছে আমার শৈশবে।
অতএব, সে আমায় ঘুঙুর পরিয়ে পালালে আজ আর নেই।
তার জারজ সন্তানেরা অলীকের চৌমাথায় বসে পাণ্ডুর প্রেমের কথা বলে।
লোক জমে, বাহবা দেয়; ঔষধ কেনে; ঘরে ফেরে; দেখি সব ফিকে।
আমি জনমে জনমে শূন্য গর্ভে ফিরে আসি।

সঙ্গত কারণেই পুরো কবিতাটি এখানে উপস্থাপন করা গেল না -ধর্মীয় অনুভূতি আবারও আহত না হয় এই আশঙ্কায়। ১৯৭৩ সালেই কবিতাটির জন্য ধর্মীয় উত্তেজনায় ফুঁসে উঠেছিল জনতা। আজকের সময় হলে হয়তো আরও ভয়াবহ পরিণতি ঘটতো।

কবিতার ভাষ্য নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভের মুখে পড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। চাপে পড়ে দাউদ হায়দারকে সেফ কাস্টডিতে নিয়ে, ১৯৭৪ সালের মে মাসে, কলকাতাগামী একটি বিমানে চড়িয়ে দেওয়া হয়। কবির পকেটে তখন ছিল মাত্র ষাট পয়সা, কাঁধের ঝোলানো ব্যাগে দুই জোড়া জামাকাপড়, একটি স্লিপার আর একটি টুথব্রাশ।

এর আগে, ১৯৭২ সালে তিনি লিখেছিলেন আরেকটি অনন্য কবিতা জন্মই আমার আজন্ম পাপ—
জন্মই আমার আজন্ম পাপ,
মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে,
বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই।
আমিও ভাবি তাই; ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো।
আমার জন্যই যখন তোমাদের এত দুঃখ আহা দুঃখ দুঃখরে!
আমিই পাপী; বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

ভারতও তাঁকে স্থায়ী আশ্রয় দিল না। বাংলাদেশও তাকে আপন করতে পারল না। দাউদ হায়দার হয়ে উঠলেন এই অঞ্চলের এক অনভিপ্রেত 'ভিনদেশি'। শেষ পর্যন্ত, নোবেলজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাসের সহায়তায় ১৯৮৭ সালের ২২ জুলাই, ভারতে ১৩ বছরের নির্বাসন শেষে জার্মানির বার্লিনে আশ্রয় নেন।

নিজের বেদনার পরিচয় তিনি মেলে ধরেন 'আমার পরিচয়' শিরোনামের কবিতায়—
ভুলে যাও ভিটেমাটি, দেশ।
তুমি উদ্বাস্তু, আশ্রিত।
তোমার স্বদেশ বলে কিছু নেই,
তুমি পরগাছা, তুমি মৃত।
...
এদেশ তোমার নয়,
এই ভিটেমাটিজমিন তোমার নয়।
তুমি আশ্রিত, উদ্বাস্তু;
এই তোমার মানব পরিচয়।

২০০৭ সালের সাপ্তাহিক ২০০০-এর ঈদসংখ্যায় লিখেছিলেন আত্মজীবনীমূলক লেখা সুতানটি সমাচার! সেখানে উঠে আসে কলকাতায় তার দুর্বিষহ শুরু। কোনো চেনাজানা আশ্রয় না পেয়ে, কখনো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কখনো শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কখনো সাগরময় ঘোষের সন্ধান করছেন টেলিফোনে। কোথাও যেন তাঁর জন্য অপেক্ষা ছিল না।

"নাম জেনে ঠাঁই দিয়েছেন, এই যথেষ্ট।
নাম শুনে ভয় পেয়েছিলেন প্রথমে। ‘আপনি দাউদ হায়দার? জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কলকাতায়? কর্মচারীদের কাছে অন্য নাম বলবেন।’
বিপদের কথা বলি তাঁকে। ‘না, আপনাকে রাখতে পারব না বাসায়, জানাজানি হলে বিপদ হবে। তাছাড়া আমার বউ অসুস্থ (পরে জানি অন্তঃসত্ত্বা)। শাশুড়ি আসবেন কাল।’
ম্যানেজার অতিশয় ডিপ্লোম্যাটিক। উপরন্তু দয়ালু। বললেন, ‘আমার ঘর থেকে যত খুশি ফোন করতে পারেন, তবে কলকাতার মধ্যে। বন্ধুদের ফোন করে বলুন আপনার সমস্যা।’
কলকাতায় আমার বন্ধু! –ও হা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে গোটা তিনেক চিঠি লিখেছিলুম, উত্তর দিয়েছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘সাপ্তাহিক কবিতা’র জন্যে চিঠি লিখেছেন। পাঠিয়েছিলুম। ‘পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় তরুণ কবিদের মধ্যে আমার কবিতাই বেশি। কেন বেশি, সম্পাদক শক্তি চট্টোপাধ্যায় কৈফিয়ৎও দিয়েছেন।
জানতুম, সুনীল-শক্তি আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করেন। ফোন করলুম। অপারেটর বললেন, ‘এখন নেই। বিকেলে চেষ্টা করবেন।’ মনে পড়ল, সাগরময় ঘোষের কথা। ‘দেশ’-এ গোটা কয়েক কবিতা লিখেছি। না, তিনিও নেই।
টেলিফোন বুকেই আনন্দবাজারের লিস্টে নাম দেখি সন্তোষ কুমার ঘোষ। ‘শ্রীচরণেষু মাকে’ পড়েছি। না, তিনিও অফিসে আসেননি।"

কবিতার জন্য জীবন দিয়ে ভিটেমাটি হারানো -এই ট্র্যাজিক আইকনের নাম দাউদ হায়দার। তাঁর জীবন হয়ে রইলো কবিতা ও দর্শনের জন্য আত্মত্যাগের অনুপম উদাহরণ।

যদি সময়ের নৃশংস অসহিষ্ণুতা একটু কম হতো, হয়তো আজ ইতিহাস তাঁকে আরও উদার হৃদয়ে স্মরণ করতো। এখন, সব কোলাহল ছাপিয়ে, কবি মহাকালকে নিজের চিরায়ত আশ্রয় করলেন। বিদায় কবি। অনাগত সহিষ্ণু তার্কিকের মর্মে থেকে যাবে তোমার অজর কবিতা।

কবিবন্ধু, লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী আজ সকালে তাঁর ফেসবুকে লিখলেন—
"আমাদের বন্ধু দাউদ হায়দার চলে গেলো আজ সকালে। অনেক কিছুই হয়েছিল, এসব ভেবে কি হবে। সেই ১৯৬৯ থেকে বন্ধু। শেষের দিনগুলা হাসপাতালে জীবিতাবস্থায় মরেই ছিল। জিয়া ভাই, রশিদ ভাই, মাকিদ ভাই আর এবার দাউদ। পঞ্চপাণ্ডবের ৪ জন বিদায় নিলো! জাহিদ এখন একা। মন খারাপ করে আর কি হবে। বিদায় দাউদ, ভালো থাকিস।"

লেখক: সাংবাদিক
২৭ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login