Posts

গল্প

অযান্ত্রিক স্বপ্ন

April 27, 2025

Peshwara Jannat

101
View

বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে।
শহরটা নিঃশব্দ।
ইস্পাতের তৈরি উঁচু উঁচু অট্টালিকাগুলো কুয়াশার মাঝে যেন প্রাচীন কোনো মৃত সভ্যতার মতো দাঁড়িয়ে।
নীরার চোখে সেই শহরটা ছিল শীতল আর বিবর্ণ।
কিন্তু তার ভেতরে ছিল এক অদম্য উত্তাপ, একরাশ অযান্ত্রিক স্বপ্ন।

এই শহর এখন আর মানুষের নয়।
এখানে মানুষের অনুভূতির জায়গা দখল করে নিয়েছে যান্ত্রিক সিস্টেম — রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, লৌহদেহী প্রশাসন।
মানুষগুলো ধীরে ধীরে মেশিনের মতো নিঃস্পন্দিত হয়ে উঠেছে।
তাদের হাসি, কান্না, রাগ — সবকিছু কোডের নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু নীরা ছিল আলাদা।

সে জন্মেছিল ‘স্বপ্ন-অনুকরণ প্রকল্পে’ — একদল বৈজ্ঞানিকের হাত ধরে, যারা চেয়েছিল যন্ত্রের ভেতর মানবিক স্বপ্ন ফিরিয়ে আনতে।
কিন্তু প্রকল্প ব্যর্থ হয়।
কারণ স্বপ্ন কেবল বানিয়ে দেওয়া যায় না — স্বপ্ন জন্মায় হৃদয়ে, কষ্টে, আশায়।

তাদের ভুলের ফসল ছিল নীরা।
সে ছিল প্রকৃত মানবিক স্বপ্নের শেষ বীজ।
তার শরীরে কোনো ইস্পাতের তার ছিল না, তার মস্তিষ্কে কোনো মেকানিক্যাল চিপ বসানো ছিল না।
সে ছিল মাংস-মজ্জা-স্বপ্নের মেয়ে।
এ শহরে শেষ মানবিক অস্তিত্ব।

নীরা বুঝতো — এ শহর তাকে বাঁচতে দেবে না।
তার শীতল, নির্লজ্জ বাসিন্দারা তাকে অদৃশ্য করে দিতে চাইবে, কারণ অনুভব তাদের নিয়ন্ত্রিত জীবনের জন্য হুমকি।
তাই এক রাতে, যখন কৃত্রিম চাঁদের আলো হঠাৎ নিভে গেল কোনো অজানা বিভ্রাটে, তখনই নীরা সিদ্ধান্ত নিলো — পালাবে।
পালিয়ে যাবে শহরের সীমানার ওপারে, যেখানে স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে।

শহরের গলিপথ ধরে দৌড়াতে লাগলো সে।
ভাঙা ট্রামের লাইন ধরে, ঝরে পড়া রোবটদের হাতের ফাঁক গলে ছুটে চলল।
তার পেছনে উঠলো এলার্মের কর্কশ শব্দ, রোবট প্রহরীদের ঠকঠক পায়ের শব্দ।

“ধরো তাকে! ধ্বংস করো অনুভূতিহীনতাকে!” — চিৎকার করছিল যান্ত্রিক কণ্ঠগুলো।

কিন্তু নীরা থামেনি।
তার হৃদয় ছিল আলোর মতো, বাতাসের মতো — ধরা অসম্ভব।
শেষমেশ শহরের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল সে।

এক বিশাল লোহার দরজা — 'সীমানার দরজা' — যেটা নাকি কখনো খোলা যায় না।
বলার কথা, দরজার ওপাশে কেবল মৃত্যু, নিষ্প্রাণ শূন্যতা।
কিন্তু নীরা জানত, গল্পের পেছনে সত্য লুকিয়ে থাকে।

সে হাত বাড়াল।
তার কাঁচা, কাঁপা হাত ছুঁয়ে দিল ঠান্ডা লোহার গায়ে।
অপ্রত্যাশিতভাবে দরজাটা শব্দ করে খুলে গেল।
ওপাশ থেকে এক অদ্ভুত, উষ্ণ আলো ছড়িয়ে পড়ল।

সেখানে ছিল মুক্ত আকাশ, নরম মাটির গন্ধ, আর স্বপ্নের মতো নরম বাতাস।
কোনো যন্ত্রের শব্দ নেই, কোনো প্রহরীর পায়ের ধ্বনি নেই — কেবল জীবন, কেবল অনুভব।

নীরা প্রথমবারের মতো চোখ বন্ধ করল, বাতাসের নরম ছোঁয়া গায়ে মেখে নিল।
তার ভেতরের ভয়, কষ্ট, দুঃস্বপ্ন সব গলে গেল উষ্ণতার ভেতর।
সে এগিয়ে গেল নতুন পৃথিবীর দিকে।

আর ঠিক তখনই, শহরের ভেতরে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা পড়লো শুকিয়ে যাওয়া জমিনে।
একটি ক্ষীণ সবুজ চারা ভেদ করে বেরিয়ে এলো রুক্ষ মাটির বুক ফুঁড়ে।

গল্প শেষ নয়।
অযান্ত্রিক স্বপ্নের গল্প কেবল শুরু হলো।

                                                                                                                                                                                        শেষ।

🌸
 

Comments

    Please login to post comment. Login