অনেকক্ষণ ধরে একটার পর একটা গ্লাস শেষ করছিল আরিয়ান।
ভেতরটা যখন পুরোপুরি জ্বলে উঠলো, তখন আরও এক গ্লাসের জন্য ইশারা করলো সে।
কিন্তু বারটেন্ডার এগিয়ে এসে বিনয়ের সাথে বললো,
— "স্যার, টাইম শেষ... আর দেয়া যাবে না।"
এই কথাটা যেন আগুন ঢেলে দিলো আরিয়ানের ক্ষতবিক্ষত মনের ওপর।
তার রক্তচক্ষুতে তাকালো ছেলেটার দিকে, গলা কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করলো,
— "তোর কি মনে হয় আমি ভিখারি? দিতে বাধে তো চাকরি ছেড়ে দে! আমার টাকা আছে, তোর পুরো বার কিনে নিতে পারি! এখন একটা গ্লাস চাই, আর তুই সেটা দিবি!"
সার্ভেন্ট একটু পেছিয়ে গেলো ভয়ে, চারপাশের কজন অতিথি চুপচাপ তাকিয়ে রইলো।
আরিয়ানের গলা ভারী হয়ে যাচ্ছিল, চোখে-মুখে হতাশা, রাগ আর প্রচণ্ড বিষাদ একসাথে জমে উঠছিলো।
তার কণ্ঠ ফাটছিলো, শরীরটাও যেন আর টিকিয়ে রাখতে পারছিলো না নিজেকে।
হঠাৎ একটু টাল সামলাতে না পেরে টেবিলের ওপর হাত ঠুকে বসে পড়লো আরিয়ান।
হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের কান্না লুকাতে চাইলেও পারলো না।
সার্ভেন্ট তখন ম্যানেজারকে ডাকতে গেলো।
চারপাশে চাপা ফিসফাস, কেউ কেউ দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিলো,
কিন্তু কেউ কাছে এসে জিজ্ঞেস করার সাহস করলো না—
"এই ছেলেটার বুকের ভেতর ঠিক কীভাবে একটুকরো পৃথিবী ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো?"
বারের ভেতর গুমোট পরিবেশ। সবাই দূর থেকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। ঠিক তখনই ভিড় ঠেলে এক অদ্ভুত ধরনের লোক এগিয়ে এলো।
চেহারায় ছাপ পড়া অশুদ্ধতা, চোখ দুটো ঘোলাটে আর পোশাক— যেন একটা সার্কাসের পুরনো জোকারের মতো বিশৃঙ্খল, এলোমেলো।
কথাবার্তাও অদ্ভুত রকমের হালকা আর ঠান্ডা, যেন গভীর জলের কোনো ভয়ঙ্কর মাছ।
লোকটা হেসে হেসে বললো,
— "ওই, আমি চিনতাম একে... পরিচিত আমার। বিল আমি দেবো। কোনো টেনশান নাই।"
ম্যানেজার একটু সন্দেহের চোখে তাকালো, কিন্তু আরিয়ানের অসহায় অবস্থা দেখে আর কিছু বললো না।
লোকটা ঝট করে টেবিলের বিল মিটিয়ে দিলো, তারপর ধীরে ধীরে অচেতন আরিয়ানকে টেনে তুললো।
আরিয়ানের চোখ আধা বুঁজে গেছে, শরীর ঢলে পড়ছে লোকটার কাঁধে। কোনো হুশ নেই, কোনো প্রতিরোধও নেই।
তাকে নিয়ে লোকটা বেরিয়ে গেলো ধীরে ধীরে... অন্ধকার রাস্তার দিকে।
চারপাশের কজন কেবল দূর থেকে দেখতে থাকলো,
কেউ জানলো না সেই মুহূর্তে একটা নতুন অন্ধকার গল্প শুরু হয়ে গেলো আরিয়ানের জীবনে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা। চারপাশ নীরব।
লোকটা অচেতন আরিয়ানকে কাঁধে ভর করে ধীরে ধীরে হাঁটছিল।
ওর পা টলছে, কিন্তু মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির হাসি।
ঠিক তখনই, হালকা হাওয়ায় ভেসে এলো আরিয়ানের অস্পষ্ট বিড়বিড় করা শব্দ।
"তৃষা... আমি তোমাকে ভালোবাসি... ভালোবাসি... ভালোবাসি..."
কান পাতলেই শোনা যায়, সেই ভাঙা ভাঙা স্বর, বুকের গভীর থেকে উঠে আসা ব্যথা মিশ্রিত স্বীকারোক্তি।
লোকটা এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল। মাথা ঘুরিয়ে আরিয়ানের ক্লান্ত মুখের দিকে তাকাল।
তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে উঠে এলো।
কী হাসি তা বোঝা গেল না— মমতার, নাকি নিষ্ঠুর আনন্দের।
তারপর আর কিছু না বলেই সে আবার হাঁটা শুরু করলো...
আর পিছনে পড়ে রইলো আরিয়ানের হৃদয়ভাঙা ভালবাসার ফিসফিসানি, যেটা অন্ধকারের সাথে মিশে যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে।
চলবে....