অধ্যায় ১: ডায়েরি :-
____________
স্কুলের লাইব্রেরিটা সবসময়ই ফাঁকা ফাঁকা লাগে রায়হানের কাছে। অন্যরা যখন মাঠে ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত, তখন সে এক কোণে বসে বই পড়ে। শব্দহীন জগতে হারিয়ে যেতে তার ভালো লাগে। বইয়ের পাতার শব্দটাই যেন তার প্রিয় সঙ্গীত।
সেদিনও ছিল তেমনি এক দুপুর। বইয়ের তাক ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ তার চোখে পড়ে একটা পাতলা, ছেঁড়া-মলিন খাতা। দেখতে পুরোনো ডায়েরির মতো। কৌতূহল থেকে সে সেটা তুলে নেয়। প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা ছিল—
" আমি মরতে চলেছি।"
রায়হান মুহূর্তেই চমকে ওঠে। কার লেখা হতে পারে? মনের অজান্তে তার আঙুল পাতার পর পাতা উল্টে যেতে থাকে।
" ডাক্তার বলেছে, আমার আর ছয় মাস বাকি। শুনে ভয় পাইনি, আশ্চর্যরকম শান্ত লাগছিল। বোধহয় ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত ছিলাম অনেকদিন ধরেই "
রায়হান যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। এ লেখা তো কেবল কোনো সাহিত্যপ্রেমীর কল্পনা নয়। এখানে যে সত্যি কোনো মেয়ের কণ্ঠ ফুটে উঠছে! এরপরই নিচে লেখা...
" আমার নাম আয়েশা। আমি চাই না কেউ আমার এই ডায়েরিটা পড়ুক। কিন্তু যদি পড়েই ফেলে, তাহলে দয়া করে আমার জীবনের শেষ কটা দিন একটু সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করো।"
এই নাম রায়হানের খুব চেনা। আয়েশা, স্কুলের সবচেয়ে প্রাণবন্ত আর জনপ্রিয় মেয়ে। যার সাথে সে কখনো ঠিকমতো কথাই বলেনি। যে সবসময় হাসে, আড্ডা দেয়, বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণ খুলে বাঁচে।
এই হাসির পেছনে লুকিয়ে ছিল এমন এক সত্য?
সে ডায়েরিটা বন্ধ করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে। মাথার ভেতর শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খেতে থাকে—
" আয়েশা মরতে চলেছে? "
অধ্যায় ২: গোপন কথা :-
_______________
পরদিন ক্লাসে রায়হান স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আয়েশাকে দেখামাত্র তার বুকের ভেতর কেমন যেন কেঁপে উঠল। আজও সেই হাসি, সেই প্রাণ—কিন্তু এখন রায়হান জানে, এই মেয়েটি বেঁচে থাকার লড়াই লড়ছে নীরবে।
দুপুরে, ছুটির ঘণ্টা পড়ার পর রায়হান সাহস করে লাইব্রেরির পাশের করিডোরে অপেক্ষা করতে লাগল। আয়েশা সাধারণত ওদিক দিয়েই যায়।
কিছুক্ষণ পর, সে এল। স্কুলব্যাগ কাঁধে, দুই বান্ধবীকে কিছু একটা বলে হেসে উঠল। রায়হান ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল,
" আয়েশা, এক মিনিট কথা বলতে পারি? "
আয়েশা একটু অবাক হলেও থামল। বান্ধবীরা চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকল, যেন জিজ্ঞেস করছে—"তুই?"
রায়হান ডায়রিটা ব্যাগ থেকে বের করে তার দিকে এগিয়ে দিল।
" তোমার এটা পড়ে গেছিল লাইব্রেরিতে। "
আয়েশা ডায়েরিটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর চোখ তুলে তাকাল রায়হানের দিকে। কোনো রাগ নেই, ভয় নেই—বরং একধরনের প্রশান্তি।
" তুমি পড়ে ফেলেছো? " তার কণ্ঠে ছিল নরম কৌতূহল।
রায়হান মাথা নিচু করে বলল, "হ্যাঁ... আমি জানতাম না, এভাবে জানা ঠিক হয়নি। কিন্তু..."
আয়েশা হেসে উঠল। " ঠিক আছে। ভয় নেই, আমি কাউকে না বলার শর্তে লিখেছিলাম না। বরং কেউ জানলে ভালো। একা একা মারা যাওয়াটা ভয়ংকর কষ্টের, জানো? "
রায়হান চমকে উঠল। মৃত্যুর কথা এত সরলভাবে কেউ বলতে পারে?
" তুমি কি আমাকে একটু সময় দেবে? শেষ কটা দিন... আমি চাই এগুলো হাসতে হাসতেই কেটে যাক। "
রায়হান ধীরে মাথা নেড়ে বলল, " আমি থাকব। কথা দিচ্ছি। "
আয়েশা একপলক তার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে এক ধরনের ক্লান্তি, কিন্তু ভেতরে যেন আলো জ্বলছে।
" তাহলে শুরু হোক আমাদের অদ্ভুত গল্পটা," বলেই সে হাঁটা দিল, যেন কিছুরই ভয় নেই।
রায়হান মনে মনে বলল,
" এই গল্পের কোনো নাম নেই, নেই কোনো প্রতিশ্রুতি… কিন্তু আমি জানি, এটা আমার জীবনের সবচেয়ে সত্য গল্প হতে চলেছে। "
অধ্যায় ৩: এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব :-
___________________
স্কুলের পরদিনেই আয়েশা রায়হানকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
" তুমি কখনও ঝড়ের মধ্যে হেঁটে দেখেছো? "
রায়হান একটু অবাক হয়ে বলল, " না, কখনও না। কেন? "
আয়েশা হেসে বলল, " চলো আজ করি। ঝড় না থাকলেও, মন তো ঝড় তুলতে পারে! "
এমনটাই ছিল আয়েশা—অদ্ভুত, অপ্রত্যাশিত, অথচ প্রাণবন্ত।
সেই দিনটা ছিল তাদের প্রথম 'আনুষ্ঠানিক' বন্ধুত্বের দিন। তারা দুজনে মিলে স্কুল শেষ হবার পর হেঁটে স্কুলের পাশে পুরনো রেললাইন ধরে। আকাশে মেঘ, বাতাসে কিছুটা শীত—কিন্তু তাদের কথাবার্তায় ছিল শুধুই উষ্ণতা।
রায়হান প্রথমবার বুঝতে পারল, আয়েশা একেবারেই আলাদা। সে মৃত্যু সামনে দেখেও বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করছে। সে প্রতিটি ছোট জিনিসে আনন্দ খোঁজে—গলির রাস্তার চা, হকারের মুখের হাসি, গলির বাচ্চাদের খেলাধুলা, অথবা হঠাৎ ছুঁয়ে যাওয়া বাতাস।
" তুমি কি সবসময় এত হাসি-খুশি ছিলে? " রায়হান একবার জিজ্ঞেস করল।
আয়েশা চোখ বন্ধ করে একটুখানি হাসল, " না, ছিলাম না। যখন জানলাম আমি মরব, তখনই ঠিক করেছিলাম—আমি কাঁদতে কাঁদতে মরব না। আমি হাসতে হাসতেই শেষটা চাই। "
রায়হান আর কিছু বলল না। তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—
এই মেয়ে কেন আমার সঙ্গে তার শেষ সময়গুলো কাটাতে চাইছে?
দিন কাটতে লাগল। প্রতিদিন স্কুলের পর তারা কোথাও না কোথাও যেত—কখনো পুরনো বইয়ের দোকানে, কখনো বৃষ্টিভেজা রাস্তার মোড়ে চা খেতে, আবার কখনো নীরব লাইব্রেরিতে পাশাপাশি বসে বই পড়তে।
রায়হান বুঝতে পারল, সে আর আগের মতো নেই। আয়েশার চোখের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত জীবনের রং আছে, যা তার ধূসর পৃথিবীটাকে রঙিন করে তুলছে।
একদিন, আয়েশা বলল—
" তুমি জানো, আমার ইচ্ছা— মরে গেলে কেউ যদি আমার হৃদয় খেয়ে নেয়, তাহলে হয়তো আমার অনুভূতিগুলো কিছুটা বেঁচে থাকবে… "
রায়হান চমকে উঠল। কৌতুক না বাস্তব—বুঝতে পারল না।
" তোমার হৃদয়ের আওয়াজ আমি শুনে ফেলেছি, অনুভব করে ফেলেছি । হয়তো সেটা খাওয়ার দরকার পড়বে না, " রায়হান আস্তে বলল।
আয়েশা তাকিয়ে রইল তার দিকে। চোখে জল নয়, একধরনের প্রশান্তি।
অধ্যায় ৪: হাসি ও কান্না :-
________________
সময় যেন ছুটে চলেছে। রায়হান প্রতিদিন আয়েশার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, কিন্তু তার ভেতর গভীর একটা ভয় জন্ম নিচ্ছে—প্রতিটা হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা নির্ধারিত বিদায়ের ছায়া।
একদিন আয়েশা স্কুলে এল না।
প্রথমবার রায়হান বুঝতে পারল, আয়েশার অনুপস্থিতি কতটা নিঃসঙ্গ করে দিতে পারে একটি সকালকে। ক্লাসের জানালায় বসে সে তাকিয়ে ছিল বাইরে—যেন একটা চেনা মুখ খুঁজে ফিরছে।
দুপুরে সে সাহস করে ফোন করল।
" হ্যালো? "
আয়েশার কণ্ঠ ক্লান্ত, কিন্তু চেনা হাসি লুকানো ছিল তাতেও।
" তুমি না থাকলে স্কুল অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগে, " রায়হান বলল।
" আজ একটু বেশি কষ্ট হচ্ছিল। হাসপাতালে গেছিলাম। প্লিজ রাগ কোরো না, " আয়েশা বলল।
" রাগ করব কেন? " কিছুক্ষণ চুপ থেকে রায়হান বলল, " আমি ভয়ে ছিলাম… যদি না ফেরো। "
প্রথমবার আয়েশা চুপ করে গেল।
তারপর নিচু স্বরে বলল, " তুমি কি জানো, কেবল তুমিই আছো এখন যে আমি যদি না ফিরি সেটার ভয় পায়। বাকিরা জানেই না আমি মরতে চলেছি। তুমি ভয় পাও, কারণ তুমি জানো… আমি সেটা পছন্দ করি। "
রায়হানের গলা ধরে এল। সে কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না
অধ্যায় ৫: বিদায় :-
____________
দিনগুলো যেন ঘড়ির কাঁটার চেয়েও দ্রুত চলে যাচ্ছে।
আয়েশা আর রায়হানের বন্ধুত্ব এখন নিঃশব্দ এক ভালবাসায় পরিণত হয়েছে—যেখানে কোনো স্বীকারোক্তি নেই, কিন্তু অনুভূতি অস্বীকার করারও নয়।
এক সন্ধ্যায়, রায়হান আয়েশাকে জানাতে চাইল… কিছু বলার ছিল।
তবে সে ভাবল, " আরও কিছু দিন সময় আছে, বলে ফেলব ঠিক। "
কিন্তু সময়? সময় তো আর কাউকে অপেক্ষা করে না।
পরদিন।
স্কুলে এসেই রায়হান শুনল—আয়েশা আর নেই।
না, কোনো হাসপাতালের বিছানায় নিঃশেষ হয়ে নয়।
হঠাৎ এক ছুরি-হামলায়, এক অপরিচিত ছিনতাইকারীর হাতে শহরের মাঝেই… আয়েশার মৃত্যু হয়েছে।
রায়হানের বুকের ভেতর যেন সবকিছু এক মুহূর্তে থেমে গেল।
এমন তো কথা ছিল না।
তারা তো আরও হাঁটত, আরও গল্প করত, রায়হান তো বলবে বলে রেখেছিল—
"তোমাকে ভালোবাসি।"
কিন্তু জীবন কিছু কথা অপূর্ণ রেখেই থেমে যায়।
সেই রাত।
রায়হান একা ঘরে বসে আয়েশার সেই পুরনো ডায়েরিটা খুলে বসেছিল।
শেষ পাতায় লেখা ছিল:
" যদি আমি হঠাৎ একদিন চলে যাই, তোমাকে শুধু এটুকু বলার ছিল—
তোমার সঙ্গ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
তোমার ভেতরে যে নীরব, সহানুভূতিপূর্ণ মানুষটা আছে, তাকে বাঁচিয়ে রেখো।
আমি চাই, তুমি যেন হাসতে শেখো… আমার জন্য নয়, তোমার নিজের জন্য। "
— আয়েশা "
রায়হানের চোখ ভিজে যায়। কণ্ঠে কোনো শব্দ আসে না।
সে ডায়েরিটার ওপর হাত রেখে ফিসফিস করে বলে—
" তোমার হৃদয় আমি রাখব আমার ভেতরে।
তুমি নেই, কিন্তু তোমার আলো এখনো আমার মধ্যে জ্বলছে। "
অধ্যায় ৬: নতুন সকাল :-
_______________
শীতের সকালে রায়হান বসে আছে লাইব্রেরির ঠিক সেই কোণায়—যেখানে প্রথমবার আয়েশার ডায়েরিটা পেয়েছিল। চারপাশে সবকিছু প্রায় আগের মতোই, শুধু আয়েশা নেই।
ডায়েরিটা এখনো তার কাছে আছে—চোখের পাতা যেমন প্রিয় স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে রাখে, তেমনি।
আজ ছুটি। স্কুলের লাইব্রেরি ফাঁকা। জানালার বাইরে কুয়াশা ঢাকা মাঠ, দূরে একটা পাখি ডেকে ওঠে।
রায়হান ডায়েরির শেষ পাতাটা আবার খুলে পড়ে। সেই লেখা—
" তুমি যেন হাসতে শেখো… আমার জন্য নয়, তোমার নিজের জন্য। "
সে জানে, আয়েশা যা চেয়েছিল, তার একটুও ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।
সে চোখ বন্ধ করে ভাবে—আয়েশার শেষ হাসিটা। সেই হাসি শুধু মৃত্যুকে নয়, জীবনকেও জিতিয়ে দিয়েছিল।
হঠাৎ করেই রায়হান উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগে ডায়েরিটা রেখে ধীরে পা বাড়ায় স্কুলের মাঠের দিকে।
আজ অনেকদিন পর মাঠে সে হাঁটছে, কুয়াশা ভেদ করে।
পাশ দিয়ে কিছু ছাত্র-ছাত্রী দৌড়ে যায়। তাদের হাসি, চিৎকার—সবকিছুই জীবনের ছন্দে ভরা।
রায়হান মনে মনে বলে—
" তুমি নেই, কিন্তু আমি আছি। আর যতদিন আমি আছি, ততদিন তুমিও আছো। "
বই লেখা, স্মৃতি রক্ষা, সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আজ রায়হান জানে—বেঁচে থাকা মানেই শুধু নিশ্বাস নেওয়া নয়, মানে অনুভব করা, ভালোবাসা, আর একে অপরকে আলোর মতো দিয়ে যাওয়া।
সে আকাশের দিকে তাকায়। সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে।
আর রায়হান হাঁটতে থাকে—এক নতুন সকালের দিকে।
[সমাপ্ত]