Posts

চিন্তা

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ছায়া: বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে?

April 30, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

270
View

ভারত ও পাকিস্তান -উভয় দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় এদের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ (full-scale war) লাগার সম্ভাবনা খুব সীমিত হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। বাস্তবতা হলো, পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাড়ায় না, বরং নিয়ন্ত্রণ করে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক ঘোষণায় সেনাবাহিনীকে 'সন্ত্রাসবাদের উৎসে গিয়ে দমন' করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি নিছক প্রতীকী হুঁশিয়ারি নয়, বরং এক প্রকার মুক্ত ছাড়পত্র। কূটনৈতিক ভাষায় একে বলে Escalation Doctrine বা যুদ্ধের অনুমোদিত বর্ধিত সীমা।

এই‌ প্রেক্ষিতে পাকিস্তান কি বসে থাকবে? তারাও তুরস্ক থেকে আনা অস্ত্রসম্ভারে নিজেদের আকাশ সীমা ও ডিপো ভরাচ্ছে। এটমিক ওয়ার হেড তাক করে রাখবার হুমকি দিয়েছে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সরকার।

পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী মোহাম্মদ হানিফ আব্বাসি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানের ১৩০টির বেশি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘এমনি এমনি সাজিয়ে’ রাখা হয়নি, এগুলো ‘শুধুই ভারতের জন্য’ রাখা হয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এ খবর দিয়েছে।

পাকিস্তানের ভেতরে সামরিক অভিযান চালানোর ইঙ্গিত যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়া আবারও অনিশ্চয়তার আগুনে পুড়বে -এ আশঙ্কা অমূলক নয়।

বাংলাদেশ সরাসরি এই যুদ্ধের পক্ষ না হলেও, ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনৈতিক অবস্থান এবং কৌশলগত ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অগত্যা এক ধরনের পক্ষ। একদিকে ভারতের সঙ্গে ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে ঘিরে রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ।

যদি প্রফেসর ইউনূস সরকার ভারতের শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হয়, তাহলে বাংলাদেশের ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। এছাড়া, বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা এখনো প্রতিরক্ষাপন্থী, আক্রমণাত্মক নয়। তাই দুই পরাশক্তির সম্ভাব্য সংঘর্ষে দেশটি শিকার হয়ে যেতে পারে এক প্রকার ‘সেফটি বাফার’ হিসেবে।

যুদ্ধ শুরু হলে সীমান্তে শরণার্থীর ঢল, বৈদেশিক বাণিজ্যে ধস, জ্বালানি সংকট, পণ্যবাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। এই পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার দিকেও ধাবিত হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের একটি প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় প্রতি মাসে বাংলাদেশে অন্তত ৫০ হাজার উদ্বাস্তু প্রবেশ করতে পারে। এটি একটি মধ্যম আয়ের দেশের জন্য বড় মানবিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশ যদি এখনই একটি কৌশলগত 'নিরপেক্ষতা নীতি' ঘোষণা করে -যেখানে সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করে, আঞ্চলিক শান্তিকে সমর্থন দেয় -তাহলে তাহলে আমাদের দেশ আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। শান্তির বার্তা, মানবিক সহায়তা, নিরপেক্ষতা -এই তিনটি রূপরেখায় বাংলাদেশ নিজেকে সংঘাতের শিকার নয়, বরং স্থিতিশীলতার মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

বাংলাদেশকে সরাসরি কোনো পক্ষের হয়ে না গিয়ে জাতিসংঘ সনদের ২য় অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে ‘অ-আগ্রাসী, শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশ’ নীতি ঘোষণা করা উচিত। এটি পাকিস্তান ও ভারতের কাছে বাংলাদেশের অবস্থানকে স্পষ্ট করবে।

বাংলাদেশের উচিত হবে ওআইসি, সার্ক ও বিমসটেক-এর মাধ্যমে কূটনৈতিক পরিসরে সক্রিয় থাকা এবং যুদ্ধ নিরসনে গণতান্ত্রিক শান্তি উদ্যোগে ভূমিকা রাখা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চাইলে চীন, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথ বিবৃতি প্রদান করতে পারে।

যুদ্ধ বা বৈশ্বিক উত্তেজনার সময় দেশীয় রাজনৈতিক বিভাজন আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সরকার ও সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্তত এই বিষয়ে একটি সর্বদলীয় কৌশলগত সমঝোতা জরুরি।

শান্তির সপক্ষে থাকা এক জিনিস, আর প্রস্তুত থাকা আরেক জিনিস। বাংলাদেশের এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ কূটনৈতিক ভাষ্য, সেনাবাহিনীর সীমান্ত প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বড় যুদ্ধ তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব হলেও বাস্তবিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং কম সম্ভাব্য। আন্তর্জাতিক চাপ, অর্থনৈতিক পরিণতি, ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কার কথা উভয় দেশের নেতার ভাবনাতেই থাকবে। ভবিষ্যতের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেকটাই নির্ভর করবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং জনগণের সচেতনতার ওপর।

ভারত ও পাকিস্তানের পরমাণু বেষ্টিত উত্তেজনার কেন্দ্রে বাংলাদেশের স্থিরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন সাহসিকতা -যা কেবল শব্দে নয়, কৌশলে প্রকাশ পাওয়া জরুরি। যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও বাংলাদেশ নিরপেক্ষ থেকে, শান্তির বার্তা দিয়ে এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার রোল মডেল হতে পারে।  যতটা সম্ভব আগেভাগে প্রস্তুত না থাকলে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির শিকার হতে পারে দেশ। আর এই প্রস্তুতি হতে হবে রাষ্ট্রীয় কূটনীতি, সামরিক কৌশল, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা এবং বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিক অভিব্যক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে।

লেখক: সাংবাদিক 
৩০ এপ্রিল ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login